সালটা ২০০৫, ভীষণ বিপদে পড়ে মুম্বাই যাচ্ছিলাম। সেই সময় সংসার চালাবার একমাত্র অবলম্বন, ঘটি বাটি বিক্রি করে কেনা, নিকন ডি৭০ কোম্পানির নকশা সংক্রান্ত ভুলের কারনে খারাপ হয়ে গেছে। নিকন অবশ্য সবাইকে নিখরচায় ক্যামেরাটা সারাই করে দিচ্ছিল। কিন্তু আমার মতন ছুটকো ছাটকা ক্যামেরাম্যান, যারা বিয়ে বাড়ির ছবি তুলে সংসার চালাতো, তাদের দুর্ভাগ্য তারা ক্যামেরা কিনতো গ্রে-মার্কেট থেকে। সুতরাং নিজের খরচায় সারাই করতে হবে। এদিকে সারাই করা যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। কোম্পানি থেকে বলা হল, ওই সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র মুম্বাই সার্ভিস সেন্টারেই হতে পারে। অগত্যা মুম্বাই। এদিকে সংসার চালাবার পয়সা নেই, ওদিকে রোজগারের একমাত্র অবলম্বন কোন সাড়াশব্দ করছে না। সুতরাং না গিয়ে উপায় নেই। সেটা জীবনে দ্বিতীয়বার মুম্বাই যাওয়া। যাওয়া আসার ট্রেনের টিকিট আর খরচ বাদে হাতে প্রায় কিছুই নেই। ট্রেনে অবশ্য ফেরা হয়নি। সেই ২০০৫-এর ভয়ঙ্কর বন্যার কবলে পড়েছিলাম। কিভাবে ফিরেছিলাম সে অন্য উপন্যাস। যাইহোক, যেটা বলছিলাম। মুম্বাই যাচ্ছি, ভীষণ ইচ্ছে সঙ্গে করে বউকে নিয়ে যাই। সে তখনো মুম্বাই দেখেনি। আর্থিক সঙ্গতি থাকলে নিয়েও যেতাম। কিন্তু উপায় নেই। বউয়ের জন্য কিছু উপহার নিয়ে আসব, তারও উপায় নেই। মনে ভীষণ দ্বন্দ্ব। তবে ছোটবেলা থেকেই দুষ্টুবুদ্ধির তো অভাব নেই মাথায়। তাই ভাবলাম চালাকির দ্বারাই মহৎ কার্য করতে হবে। ঠিক করলাম, ট্রেনে যেতে যেতেই হাবিজাবি কিছু লিখে ফেলবো। তারপর মুম্বাই পৌছেই সেটাকে বাড়ির ঠিকানায় স্পিড পোস্ট করে দেব বউয়ের উদ্দেশ্যে। যাতে আমি ফেরার আগেই সেটা বউয়ের হাতে পৌঁছে যায়। বউ ভোলানো কায়দা আর কি। ট্রেনে যেতে যেতেই আমার অভিজ্ঞতা লিখে ফেলেছিলাম। প্রথমে লেখাটার নাম দিয়েছিলাম “গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস”। পরবর্তীকালে লেখাটায় সামান্য কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। ইদানিং বেশ কয়েকজন আমাকে বলেছেন, আমার লেখা নাকি জটিল হয়ে যাচ্ছে। তাই পুরনো লেখা ঘাটতে ঘাটতে এটা হাতে পেয়ে গেলাম। দেখলাম সত্যিই আগে আমি এত জটিলেশ্বর ছিলাম না। ভালো হচ্ছে, না খারাপ হচ্ছে জানিনা, তবে বেশ বুঝতে পারছি লেখার ধরন গত ২০ বছরে পাল্টে গেছে। আপনারা কি বলেন?
“পরিযায়ী শ্রমিক এক্সপ্রেস”
পাশাপাশি দুটো লোহার পাত্তির উপর পিছলে পিছলে
বাড়ি ফিরে যাচ্ছি আমি পরিযায়ী শ্রমিক।
ইট, কাঠ, কংক্রিটের জঞ্জাল পিছনে ফেলে
ঢুকে পড়েছি খড়ের গাদার ভারতবর্ষে।
জীবন, জীবন, তোমাকে ভুল ব্যাখ্যা করেছি কত।
এখন মনে হচ্ছে তুমি একটা রেলগাড়ি।
আমি বলিনি, রেল নিজেই বলে দিল কানে কানে।
আমার যাত্রা শুরুর ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে রেলমন্ত্রী,
আদম আর ইভের মতোই যাত্রা শেষ হবে নিশ্চিত।
আমি বলি, ওহে রেল, তুমি চালকের অধীন।
আমি বলিনি, রেল নিজেই বলে দিল কানে কানে,
জীবনেরও চালক আছে, শুধু তুমি দেখতে পাও না।
আমার জীবন নিয়ে ছুটে চলেছে রেল, ভারতবর্ষ চিরে,
বিশ্বকর্মার তুলির জাদু জানালার ক্যানভাসে।
লাল মেঠোপথ, ধানক্ষেত, কুমকুমের মতো রঙিন
স্নিগ্ধ সূর্য, গোলাকার চাঁদ আর গোটা পাঁচেক তারা,
অখন্ড আকাশে ধোঁয়াশার মত সব মিলেমিশে।
অস্পষ্ট সেই মেয়েটা অপেক্ষা করছিল পথ চেয়ে,
স্বপ্নে দেখেছি যাকে, যার কেউ আসবার নেই রেলে চড়ে,
তবু সে অপেক্ষা করে থাকতো প্রতিদিন বিকেলে।
রেল গাড়িটার সঙ্গেই যত সখ্যতা তার।
আমার জীবন নিয়ে ছুটে চলেছে রেল রাত্রির বুক চিরে,
জোরে আরো জোরে, ওর চঞ্চল হৃদপিন্ডের শব্দ,
ঢিকঢিকঢিকঢিক, ঢিকঢিকঢিকঢিক, ঢিকঢিকঢিকঢিক,
মোল্লা চাচার নামাজ পড়ার সময় হয়েছে যখন,
বিহারী শ্রমিক সরে যায় ছাতুর প্যাকেট নিয়ে,
আমি বলিনি, রেল নিজেই বলে দিল কানে কানে,
হুউউউউউউউউউ, ঠিকঠিকঠিকঠিক, ঠিকঠিকঠিকঠিক,
বাঙালি বিহারীর সিট পড়েছে পাশাপাশি,
সাপে-নেউলে ধুন্ধুমার ঝগড়া বেধেছে, রেল বলে ওঠে,
ছিই-ই-ই-ই-ই-ই-ই, ধিকধিকধিকধিক, ধিকধিকধিকধিক।
এক ঝাঁক সাঁওতাল মেয়েকে নাচতে দেখেছিলাম,
আমার জীবন নিয়ে ছুটে চলে রেল সেই নৃত্যের তালে তালে।
কাকভোরে এখনো সব রং ওঠেনি ঘুম থেকে,
লাল নীল উঠে পড়েছে সবার আগে।
রেলের গোপনাঙ্গ থেকে দুর্গন্ধ ভেসে আসে,
পরিযায়ী শ্রমিককে তবু গোপনাঙ্গ উন্মোচিত করতে হয়।
উন্মত্ত হাতির পালের মতন সব ধরাধরি করে ছুটে চলে,
পালের গোদা টা হুঙ্কার ছাড়ছে বাতাস চিরে।
কামরা সাফ করতে আসেনি লক্ষ্মী আর গণেশ,
মা দুগ্গা তাদের আটকে রেখেছে মারণ রোগের ভয়ে।
বাড়ি ফিরে যাচ্ছি আমি পরিযায়ী শ্রমিক,
কুউউউউউউ, ঝিকঝিকঝিকঝিক, ঝিকঝিকঝিকঝিক।
Copyright © Jewel Chanda
Author
-
Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com
View all posts