পর্ব - ছয়
আত্মনং বিদ্ধি
ওগাবুর জার্নাল লগ পড়ার আগে, জার্নাল লগ সম্পর্কে দু একটা কথা বলে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে। যে সময়ের কথা বলছি সেটা ২০৪৫ সাল। জার্নাল লগ হল প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে হাতে লেখা ডাইরির বিবর্তিত এবং উন্নত সংস্করণ। মানুষ একসময় হাতে ডাইরি লিখতো। তারপর পার্সোনাল কম্পিউটারের যুগে ডাইরি বিবর্তিত হয়ে হয়ে যায় ইলেকট্রনিক ডায়েরি বা ই-জার্নাল। ইউ.সি.এস -এর যুগে তা রূপান্তরিত হয়ে হয় জার্নাল লগ। আসলে ব্যাপারটা সেই দিনপঞ্জিই, কিন্তু লিখতে হয় না। আমি যদি চাই এই মুহূর্তে আমি যা চিন্তা করছি তার একটা কপি ইউ.সি.এস-এ রেকর্ড হয়ে থাকুক, তাহলে আমার সেই চিন্তা ভাবনা গুলো আমার জার্নাল লগে রেকর্ড থাকবে। তবে জার্নাল লগে আমার সমস্ত চিন্তাভাবনা ধরা পড়বে না। আমার চিন্তা ভাবনার শুধু সেই অংশটাই রেকর্ড হবে যে অংশটা আমি চাই রেকর্ড থাকুক। প্রযুক্তিগতভবে ইউ.সি.এস মানুষের মনের যেকোনো অংশেই নজরদারি চালাতে সক্ষম হলেও সে ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়নি। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এড়াতে যে ‘রুল অফ এথিক্স’ কোড করা হয়েছে তা লঙ্ঘন করে মানুষের মনে উকি মারার ক্ষমতা ইউ.সি.এস-এর নেই।
ওগাবুর জার্নাল লগের সবটা আমি এখানে বলছি না। এখানে শুধু সেটুকুই বলছি যেটুকু এই গল্পের জন্য প্রাসঙ্গিক।
মার্চ 1, 2045।
আজ একটা মেল পেয়েছি। পাঠিয়েছে জনৈক আলেকজান্ডার মারমান্ডু ফ্রম ব্রাজিল। একটা পেপার (গবেষণাপত্র) পাঠিয়েছে। আমার প্রী-রিভিউ কমেন্ট পেলে ওর সুবিধে হয়। পেপারের টাইটেলটা দেখে ভাবলাম সুকুমারের উত্তরসূরি বুঝি। ‘আর উই এনট্যাঙ্গলড?’ তরুণ প্রজন্মের কেউ তাত্ত্বিক বিজ্ঞান চর্চা করছে ভেবে একটু অবাক হলাম। এযুগেতো অনেকেই মনে করে, হার্ড সায়েন্স ইজ আ কম্পিউটেশনাল প্রবলেম। অবশ্য মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। সায়েন্স জার্নালগুলো একে একে সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে বিজ্ঞানের যাবতীয় উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের পিছনেই ইউ.সি.এস। শেষ যে কয়েকটা প্রশ্নের সমাধান সে এখনো করতে পারেনি, সেগুলোকে এখন আল্টিমেট কোশ্চেনস বলা হয়। আলেকজান্ডারের পেপারে তেমনই একটা আল্টিমেট কোশ্চেনের সমাধানের ইঙ্গিত আছে। আজকাল অনেকেই ধর্ম আর বিজ্ঞান মিশিয়ে একটা জগাখিচুড়ী তত্ত্ব খাড়া করে। এই পেপারটা কিন্তু সেরকম সুডো সায়েন্স নয়। এর উপসংহার গুলো সিমুলেশন মডেলে প্রমাণিত। এই পেপারটার সারমর্ম হল:
হিন্দু ধর্ম মতে বেদ পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ। দাবি করা হয় ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত বাণী যা কিনা চূড়ান্ত বা আলটিমেট নলেজ। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সৃষ্টি রহস্য। প্রাচীন ভারতীয় মুনি-ঋষিরা মনে করতেন বেদ অধ্যয়ন করলে ব্রহ্ম জ্ঞান লাভ করা যায় অর্থাৎ সৃষ্টির সকল রহস্যের সমাধান আছে বেদ-এ। আলেকজান্ডারের মতে বেদ-এর সবথেকে প্রাচীন খন্ড ঋগ্বেদ ২৫০০ – ২১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংকলিত হলেও বেদ আসলে আমাদের ব্রম্ভান্ডের থেকেও পুরনো। বেদ যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, তাই বেদের উৎপত্তি ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তির আগে। এ কারণেই বেদ কে বলা হয় অপৌরুষেয়। অর্থাৎ পুরুষ দ্বারা সৃষ্ট নয়, অলৌকিক। এই চূড়ান্ত ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলে যেমন সৃষ্টি করা যাবে আর একটা ব্রহ্মাণ্ড, তেমনি এর দ্বারা ব্রহ্মাণ্ডকে ধ্বংসও করা যায় এক মুহূর্তে। একারণেই বেদ প্রথম থেকে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। বেদ হলো শ্রুতি যা সৃষ্টিকর্তার থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম শ্রুত হয়েছে। আলেকজান্ডার সিমুলেশন মডেলের মাধ্যমে দেখিয়েছে, প্রত্যেকবার এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে মৌখিক হস্তান্তরের ফলে কিছু তথ্য বিকৃত হয়েছে এবং কিছু তথ্যের ক্ষয় হয়েছে। যাকে সাধারণভাবে বলা হয় ইনফর্মেশন লস। বারবার ইনফরমেশন লসের ফলে, বেদ-এর বর্তমান সংকলনে আর আসল কোন তথ্যই খুঁজে পাওয়া যায় না। বারবার ইনফর্মশন লস হওয়ার জন্য আসল ব্রহ্ম জ্ঞান বেদ থেকে হারিয়ে গেছে। আলেকজান্ডার এর মতে যদি সত্যিই ব্রহ্মা, ধরে নেওয়া যাক কোন এক উন্নততর বুদ্ধিসত্তা, এই ব্রহ্মাণ্ড এবং প্রাণের সৃষ্টি করেছেন, তাহলে মৌখিক হস্তান্তরের ফলে যে ইনফর্মেশন লস হবে সেটা তিনি জানতেন। এবং এটা আন্দাজ করা খুব কঠিন নয় যে বারবার মৌখিক হস্তান্তরের ফলে লিপিবদ্ধ হবার আগেই সৃষ্টি রহস্য চিরকালের মতন হারিয়ে যাবে। তাই ব্যাকআপ প্ল্যান থাকা স্বাভাবিক। অনেক ধর্মতত্ত্ববিদদের মতে, বেদ প্রাচীন ঋষিদের গভীর ধ্যানে প্রকাশিত হয়েছিল। আলেকজান্ডারের সিমুলেশন মডেল ইঙ্গিত করে সৃষ্টি রহস্যের একটা অনুলিপি (কপি) সৃষ্টির মধ্যেই কোথাও থাকা উচিত। যেটা উদ্ধার করতে পারলে তবেই ব্রহ্মান্ডের সকল রহস্যের সমাধান সম্ভব।
প্রথমে বিজ্ঞানের পেপার ভেবেছিলাম বলে পেপারটা প্রথমবার পড়ার পর একটু নিরাশ হয়েছিলাম। তবে ধর্মের বিজ্ঞানভিত্তিক যে পর্যালোচনা আলেকজান্ডার করেছে তা কিন্তু একেবারে ফেলে দেওয়ার মতন নয়। বরং ওর উপসংহারটা যথেষ্ট সম্ভাবনাময় মনে হচ্ছে।
আগস্ট 2, 2045।
কাল সারারাত উত্তেজনায় ঘুম হয়নি। আলেকজান্ডারের পেপারটা কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছিল না। সত্যিই কি সৃষ্টির রহস্য আমাদের চোখের সামনেই আছে? তাই যদি হয় কোন না কোন সূত্র তো নিশ্চয়ই থাকবে সেটা খুঁজে বার করবার। এতদিন সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থ গুলো কাটাছেঁড়া করেও কোন সূত্র বার করতে পারছিলাম না। অথচ সূত্র শুরু থেকেই চোখের সামনে ছিল। ইসস্! এই সহজ জিনিসটা এতদিন বুঝতে পারিনি। অথচ 1893 সালেই স্বামী বিবেকানন্দ নামক এক ভারতীয় সাধু এ ব্যাপারটা জলের মতন ব্যাখ্যা করেছেন।
‘আত্মনং বিদ্ধি।’
‘দেহের ভিতর অবাক কান্ড, দেহেই নাচে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।’
মনে হচ্ছে সৃষ্টি রহস্যের খুব কাছাকাছি এসে গেছি। একেবারে নিশ্চিত হয়েই সুকুমারকে চমকে দেব। যাক ইতিহাসের পাতায় অন্তত এটা লেখা থাকবে যে সৃষ্টি রহস্যের সমাধান করেছিল কোন মানুষ, কোন নির্জীব যন্ত্র নয়।
(চলবে……………… পড়ুনন পরবর্তী পর্ব – সমাধি)
Author
-
Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com
View all posts