পর্ব - সাত
সমাধি
ডক্টর সুকুমার, ওগাবুর জার্নাল লগ পড়তে থাকে।
(ডক্টর ওগাবুর জার্নাল লগে স্বামী বিবেকানন্দের অরিজিনাল কোট গুলো যদিও সাধু ভাষায় লেখা পাঠকদের সুবিধার্থে সেগুলো এখানে আমি সিঙ্গেল কোটেশন এর মধ্যে যতটা সম্ভব সরলীকরণ করে উপস্থাপন করছি)
আগস্ট 3, 2045
ভাবতে অবাক লাগছে এই 2045 সালেও যে প্রশ্নের উত্তর আমাদের বিজ্ঞান দিতে পারেনি তা আজ থেকে দেড়শ বছর আগে এক ভারতীয় সাধু বিশদে ব্যাখ্যা করে গেছেন।
‘জগত কোথা থেকে আসে, কোথায় অবস্থান করে, এবং কিসেই বা লীন হয়?’
এই তো আল্টিমেট কোশ্চেন, যার উত্তর আমরা আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি।
‘মুক্তি থেকে এর উৎপত্তি, বন্ধনে এর স্থিতি, এবং সবশেষে মুক্তিতেই এর প্রত্যাবর্তন। এই ব্রহ্মাণ্ড এক অনন্ত চেতনার প্রকাশ। আমরা যাকিছু দেখছি, যা কিছু অনুভব করছি, সবই সেই অনন্ত সদা বহমান সত্তার এক অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।’
কনসাসনেস বা চেতনা যে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা, ভর ও সময়ের মতন একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ ফান্ডামেন্টাল প্রপার্টি হতে পারে তা নিয়ে বৈজ্ঞানিকেরা সিরিয়াসলি চিন্তাভাবনা শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড চামার্স 1995 সালে উপস্থাপন করেছিলেন, ‘হার্ড প্রবলেম অফ কনসাসনেস’ অর্থাৎ ‘চেতনার গুরু সমস্যা।’ আমাদের মস্তিষ্ক যদি সহস্রকোটি নিউরন দিয়ে তৈরি একটা বড়োসড়ো প্রসেসর হয়, তাহলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আমাদের পারিপার্শ্বিক জগত সম্পর্কে আমাদের যাবতীয় সচেতন অভিজ্ঞতা, আমাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনা, অনুভূতি, আবেগ, সমষ্টিগত ভাবে আমাদের চেতনার সৃষ্টি হয় আমাদের মস্তিষ্ক থেকে। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক যা কিনা হাতে ধরলে একটা 1.3 কিলোগ্রামের ঘন থকথকে ধূসর পদার্থের মতন দেখতে দলা পাকানো একটা জিনিস, তার থেকে গভীর চেতনার উৎপত্তি সম্ভব নয়। তাই চেতনার এই গুরু সমস্যার সমাধানের জন্য বৈজ্ঞানিকেরা পরবর্তীকালে প্যানসিচিজমকেই প্রাধান্য দিতে শুরু করেন। প্যানসিচিজম এমন একটি তত্ত্ব যা বলে, চেতনা বিশ্বজগতের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য যা সমগ্র বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান। কিন্তু চেতনা যে সত্যিই একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য যা কিনা ব্রহ্মান্ডের সর্বত্রই বিরাজমান সেটা পুরোপুরি অংক কষে প্রমাণ করা গেছে এই ভারতীয় সাধুর মৃত্যুর প্রায় দেড়শ বছর পরে। মার্ক টেলর 2018 সালে তার ‘আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান’ বইতে বিজ্ঞান ও ধর্মের মেলবন্ধন সম্পর্কে যা ব্যাখ্যা করেছেন এবং যা যা ব্যাখ্যা করতে পারেননি, সবটাই পেয়ে গেছি এই ভারতীয় সাধুর লেখায়। মুক্তি থেকেই ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, আবার মুক্তিতেই শেষ। মুক্তি কিভাবে লাভ করা যাবে তারও একটা ইঙ্গিত দেওয়া আছে এই ভারতীয় সাধুর লেখায়।
‘মুক্তি লাভ করতে হলে এই জগতের সীমা অতিক্রম করে যেতে হবে। যদি আমরা ইন্দ্রিয় ও মনের দ্বারা সীমাবদ্ধ এই ক্ষুদ্র জগত ত্যাগ করতে পারি, তবেই আমরা মুক্ত হতে পারব। সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় এ জগতের সমুদয় নিয়মের বাইরে যাওয়া। এর জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত উন্নত প্রবল ইচ্ছাশক্তির। আমাদের ইন্দ্রিয় গুলোর মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্ক যে সচেতনতার মায়াজাল সৃষ্টি করে তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। যারা ঈশ্বর অথবা বাইরের কোন সহায়তায় বিশ্বাস করে না, তারাও প্রবল ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমে সকল আসক্তি ত্যাগ করে ইন্দ্রিয়োত্তর অবস্থা অর্জন করতে পারে। ভারতবর্ষে যত বেদানুগ দর্শনশাস্ত্র আছে, সকলেরই লক্ষ পূর্ণতা লাভ করা অর্থাৎ মুক্তি। এর উপায় যোগ। আমাদের সকল জ্ঞানই অভিজ্ঞতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এও এক অভিজ্ঞতা লব্ধ বিজ্ঞান। প্রত্যেক বিজ্ঞানের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি আছে। কোন জ্ঞান লাভ করতে হলে আমরা প্রথমে পর্যবেক্ষণ করি, তারপর সেই পর্যবেক্ষণের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হই। চরম জ্ঞানের একমাত্র উপায় একাগ্রতা। একাগ্র মন নিজের অতি অন্তরতম রহস্যগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ করে দেবে। আমাদের বহির্জগৎ আমাদের অন্তর জগতের অর্থাৎ সূক্ষ্ম জগতের স্থূল রূপ মাত্র। সচেতন মন পরিবর্তনশীল, সব সময় তা আন্দোলিত হচ্ছে। একমাত্র সিদ্ধ অবস্থায় মন ও ইন্দ্রিয়ের যোগাযোগ ছিন্ন হয়। এই বিশ্বজগতে মানুষ সব থেকে উৎকৃষ্ট জীব তার কারণ একমাত্র মানুষই ব্রহ্ম জ্ঞান লাভের অধিকারী। মানুষ সকল প্রকার জীবজন্তু এমনকি দেবতা থেকেও উচ্চতর। মানব দেহ ধারণ না করলে স্বয়ং দেবতাও ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে পারে না। সমস্ত জগৎ প্রাণের তরঙ্গে আন্দোলিত হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে এই ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এক সদা আন্দোলিত তরঙ্গ জালিকা। ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করতে হলে মনকে ইন্দ্রিয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্পন্দনের সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যেতে হবে। যোগশাস্ত্রে এই অবস্থাকেই বলা হয় সমাধি।’
বিজ্ঞানের থেকে দেড়শ বছর এগিয়ে থাকা এক ভারতীয় সাধুর বক্তব্য ইউনিভার্স এক অনন্ত চেতনার প্রকাশ। অর্থাৎ ইউনিভার্স ইজ কনসাস। একদম খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সঙ্গে। কনসাসনেস ইজ আ ফান্ডামেন্টাল প্রপার্টি। মন থেকে ইন্দ্রিয়কে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই সমাধি। অর্থাৎ বিয়ন্ড কনসাসনেস। ব্রহ্ম জ্ঞান, অর্থাৎ সৃষ্টির সকল রহস্যের সমাধান। দ্য ওয়ার্ল্ড বিয়ন্ড কনসাসনেস।
অন্যদিকে ‘আত্মনং বিদ্ধি’। মানে নিজেকে জানো, নিজেকে জানলেই জানা যাবে ব্রহ্মাণ্ডকে। এই জন্যই একই কথা ঘুরিয়ে বলা হয়, ‘দেহের ভিতর অবাক কান্ড, দেহেই নাচে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।’
অর্থাৎ আলেকজান্ডার মারমান্ডুর উপপাদ্য একশ শতাংশ সঠিক। সৃষ্টি রহস্যের একটা অনুলিপি (কপি) রয়েছে সৃষ্টির মধ্যেই। আর তার নাগাল পাওয়ার উপায়, সমাধি।
(চলবে………… পড়ুন পরবর্তী পর্ব- মোক্ষ)
Author
-
Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com
View all posts