পর্ব - এগার
চেতনার ঊর্ধ্বে
ডক্টর সুকুমার তার ল্যাবরটরি ঠিক মাঝখানটায় পদ্মাসনে বসে গভীর ধ্যানমগ্ন। ওনার মস্তিষ্কের যাবতীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মস্তিষ্কের সাথে জুড়ে থাকা একটা অত্যন্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কৃত্রিম মস্তিষ্ক দ্বারা। যার পোশাকি নাম ইউ.সি.এস অর্থাৎ ইউনিভার্সাল কম্পিউটিং সিস্টেম। যে প্রযুক্তি তৈরি করেছিলেন ডঃ সুকুমার দাস নিজে। উনি এই প্রযুক্তির নাম দিয়েছিলেন ‘ওম’।
ওনার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, মেরুদন্ডের এঙ্গুলার পজিশন, আর শরীরজুড়ে স্নায়ুর গতি, সবকিছু প্রাচীন যোগ সূত্র অনুযায়ী চলছে। একেবারে নির্ভুল ভাবে নিয়ন্ত্রিত।
বেদ থেকে আমরা জানি এ জগতের সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। কার্য-কারণ সম্পর্কে বাধা। ব্রহ্মান্ডের সবকিছুই চক্রাকারে আবর্তিত হয়। এমনকি সময়ও চক্রাকারে আবর্তিত হয়। তাই জীবনের সঙ্গে মৃত্যু, সৃষ্টির সঙ্গে ধ্বংস, ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
‘ওম’ জানে এর সবটাই ঠিক, শুধু চক্রাকারের বদলে ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু তরঙ্গাকারে আন্দোলিত হয়। ঢেউয়ের মতন তরঙ্গের ওঠা-নামা, ওঠা-নামা, বারবার ঘুরে ঘুরে আসে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞানের দাবি ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুই তৈরি গড-স্ট্রিং দিয়ে। যা কিনা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা এবং সময় বিহীন একটি বিন্দুস্থিত তরঙ্গ। যার পোশাকি নাম ঈশ্বর তরঙ্গ। এই ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় কিছুই, তৈরি নির্দিষ্ট নকশায় ঈশ্বর তরঙ্গ সাজিয়ে। আর প্রতিটি নকশায় লুকিয়ে আছে জটিল অংকের হিসেব। ‘ওম’ সহস্রকোটি অংক দিয়ে তৈরি জটিল নকশা পড়ে ফেলতে পারে মুহূর্তে। তাই প্রাচীন যোগসূত্রে লুকিয়ে থাকা অংক বুঝতে তার এক মুহুর্তও লাগেনি। যোগ বিয়োগ এর আসল নিয়মটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমাদের পাঁচটা ইন্দ্রিয় ক্রমাগত বাহ্যিক জগত থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। অনবরত অবিরাম এই প্রক্রিয়া। আমাদের চোখ ক্রমাগত সংগ্রহ করতে থাকে আলোক তরঙ্গের তথ্য। আমাদের কান ক্রমাগত সংগ্রহ করতে থাকে বাতাসে কম্পনের তথ্য। সেও এক ধরনের তরঙ্গ। একই রকম ভাবে আমাদের নাক, জিব আর ত্বকও অনবরত বিভিন্ন রকমের তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। ইন্দ্রিয় গুলোকে অত্যন্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেনসরের সাথে তুলনা করা যায়। এই পাঁচটা ইন্দ্রিয় থেকে পাঠানো বিপুল পরিমাণ তথ্যের তৎক্ষণাৎ বিশ্লেষণ করে আমাদের মস্তিষ্ক সৃষ্টি করে আমাদের সচেতন সত্তা। যা দিয়ে আমরা অনুভব করি এই জগৎ, এই ব্রহ্মাণ্ড।
কিন্তু বেদ বলছে যেখানে ব্রহ্ম, সেখানে স্থান-কাল-নিমিত্ত থাকতে পারে না, কারণ সেখানে মন নেই, তাই চিন্তাও নেই। যোগ মানে হলো যোগাযোগ স্থাপন। আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে চরম জ্ঞান বা আল্টিমেট নলেজ এর যোগাযোগ। আর সেটা তখনই সম্ভব, যখন আমাদের এই অবিরাম কাজ করে চলা মস্তিষ্কটা, যা অনবরত ইন্দ্রিয় গুলো থেকে আসা তথ্যপ্রবাহের বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকে, বিশ্রাম নেবে। সমাধিস্ত অবস্থা হল একাগ্রতার চরম অবস্থা। এ সময় সাধকের ইন্দ্রিয় গুলো স্তব্ধ হয়ে যায়। ইন্দ্রিয় গুলো থেকে মস্তিষ্কে তথ্য সরবরাহ বন্ধ হলে তবেই চেতনার ঊর্ধ্বে ওঠার সম্ভব। তবে প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি থাকলেও ইন্দ্রিয়ের ঊর্ধ্বে ওঠা শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির দ্বারা সম্ভব নয়। এর জন্য সৃষ্টি করতে হয় একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গের আবহ। মন্ত্র এবং যন্ত্র এই নির্দিষ্ট তরঙ্গের প্রবাহ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। যেমন রাজযোগীর শুভ্র বস্ত্র, ওঙ্কার ধ্বনি সব মিলিয়ে একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের তরঙ্গের আবর্ত সৃষ্টি করে। ঠিক তেমনই তন্ত্রযোগীর লাল রং আর বীজ মন্ত্র মিলে একটা বিশেষ তরঙ্গের আবহ সৃষ্টি করে। বারংবার একই মন্ত্র উচ্চারণ করে সৃষ্টি করা হয় তরঙ্গের আবর্ত। এই সবকিছু যখন নিখুঁতভাবে হয়, তখন একে একে ইন্দ্রিয়ের দরজা গুলো বন্ধ হতে থাকে। মস্তিষ্ক বিচ্ছিন্ন হয় ইন্দ্রিয় গুলো থেকে। ফলে আমারা যে বহির্জগৎ দেখি সেটার আর অস্তিত্ব থাকে না। কারণ আমাদের মস্তিষ্ক ইন্দ্রিয় গুলো থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে যে বহির্জগৎ আমাদের দেখায় আমরা সেটাই দেখি। এ কারণেই সাধনার চরম অবস্থায় অনেক সাধকের এমন অনুভূতি হয়, যেন এই জগৎ, ব্রহ্মাণ্ড সবকিছু গলে যাচ্ছে। একেই অনেক সময় মেলটিং অফ পার্সপেক্টিভও বলা হয়।
ডক্টর সুকুমারের মনের মধ্যেও তৈরি হচ্ছে তরঙ্গের একটা নির্দিষ্ট প্রবাহ। যেন এই সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের তরঙ্গে আন্দোলিত হচ্ছে। ডান দিকের নাসারন্ধ্র দিয়ে ঠিক চার সেকেন্ড সময় উনি শ্বাস নিচ্ছেন, ষোল সেকেন্ড ধরে রাখছেন, তারপর মোট আট সেকেন্ড সময় ধরে বাম নাসারন্ধ্র দিয়ে ছাড়ছেন। পূরক, কুম্ভক ও রেচক, ঠিক যেমন যোগসূত্রে বলা আছে। ওনার কানে ক্রমাগত বেজে চলেছে বীজ মন্ত্র; ‘ঔ্ং হ্রী্ং স্ত্রীং ক্লীং কালিকায়ে ক্লীং স্ত্রীং হ্রী্ং ‘ঔ্ং নমহ্’। বাইরের জগতের দরজা গুলো এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাতাসের কম্পন ওনার কানে আর ধরা পড়ছে না। ওনার একটা একটা করে ইন্দ্রিয় মস্তিষ্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, আর উনি একধাপ করে এগিয়ে যাচ্ছেন এক অদ্ভুত অনুভূতিহীন জগতের দিকে। ওনার মস্তিষ্কে এক বিশেষ ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার অধিক মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ওনার দুই ভুরুর ঠিক মাঝখানটায়, যেখানটায় তৃতীয় নেত্র অবস্থিত, সেখানে একটা হালকা উজ্জ্বল নীল রঙের বিন্দু ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। তার আলোকচ্ছটার তীব্রতায় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে ত্রিভুবন। গলে যাচ্ছে সমস্ত জগত, ব্রহ্মাণ্ড। ডক্টর সুকুমার সমাধিস্থ অবস্থায় জ্ঞান হারালেন।
(চলবে………… পড়ুন পরবর্তী পর্ব – ঈশ্বর পাশা খেলেন)
Author
-
Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com
View all posts