বাংলা ভাষায় বিগ ব্যাং তত্ত্বের উপর লেখা নিবন্ধ – “সৃষ্টি রহস্য ও বিগ ব্যাং”

Bigbang Artwork
লেখক সৌমেন চক্রবর্তী সহজবোধ্য বাংলায় ব্যাখ্যা করেছেন ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্যের। পেশায় শিক্ষক এবং অত্যন্ত প্রতিভাশালী লেখক সাহিত্যের সব আঙ্গিকেই সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। পড়ুন বাংলায় লেখা “সৃষ্টি রহস্য ও বিগ ব্যাং”

Share This Post

"সৃষ্টি রহস্য ও বিগ ব্যাং"

বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটন নিকষ কালো অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো। তবে বিশ্বকবির ভাষায়:

“অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো”

ভৌত বিশ্বতত্ত্বে মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রদত্ত একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। এই তত্ত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কোনও ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার পরিবর্তে একটি বিশেষ মুহূর্তে মহাবিশ্বের উদ্ভব। কোন এক সুদূর অতীতে এক অবর্ণনীয় টালমাটাল অবস্থা থেকেই মহাবিশ্ব জেগে উঠেছিল। সেই অবর্ণনীয় টালমাটাল অবস্থাটি ছিল বিন্দুবৎ, যার মধ্যে নিহিত ছিল অসীম অজানা মহাবিশ্বের বীজ। তখন মহাবিশ্বের সমস্ত কিছু এতটাই ঘনসন্নিবিষ্ট অবস্থায় ছিল যে, তার ঘনত্ব অসীম হয়ে যায়। অথচ আয়তন ছিল শূন্যবৎ। ভাবলেও অবাক লাগে সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের স্থিতি একটি বিন্দুতে, যার নেই কোন আয়তন। সেই কল্পনাতীত বিন্দুবৎ দশাকেই বিজ্ঞানের ভাষায় নাম দেওয়া হয়-‘ অনন্যতা’ বা ‘সিঙ্গুলারিটি’। এই অনন্যতা চাক্ষুষ করা যায়না। এটি কল্পনারও অতীত। 

 

এর মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় ছিল অসীম ক্ষুদ্র মহাবিশ্বের সকল কিছু। একে বলা হয় ‘মহাজাগতিক বীজ’ বা ‘কসমিক এগ’। এই সিঙ্গুলারিটির কাছে আমাদের সমস্ত জ্ঞান স্তব্ধ হয়ে যায়। বিজ্ঞানের সমস্ত সূত্রাবলী এই তথাকথিত অসীম ঘনত্ব, অসীম স্থান কাল, অসীম উষ্ণতার ব্যখ্যা দিতে অসমর্থ হয়। এই সময়ে ত্রাতা হয়ে দেখা দেয় আইনস্টাইনের ‘বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব’। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীদ্বয় স্যার রজার পেনরোজ ও স্টিফেন হকিংয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বের সাহায্যে  প্রমাণিত হয় যে- মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছিল একটি বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতা দিয়ে। তবে অনন্যতার ব্যখ্যা দিতে আপেক্ষিকতাবাদ পারেনি।

কেমন ছিল সেই মহাবিস্ফোরণ?

সৃষ্টিতত্ত্বের বর্তমান ব্যখ্যা অনুযায়ী, সৃষ্টির আদি সেই ক্ষণে বস্তু ও শক্তি একত্রিভূত হয়ে একটি আদিম জড়পিন্ড (Primeval body) তৈরি হয়েছিল। এবং ধারণা করা হয় যে, এই পিণ্ডের হঠাৎ বিস্ফোরণ, এই মহাবিশ্বের উৎপত্তির মূলে।

বিস্ফোরণের পূর্বের ওই আদিম পিন্ড কে ভ্রূণ মহাবিশ্ব (Embryonic universe) নাম দেওয়া হয়। বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রবক্তা বেলজিয়ান বিজ্ঞানী জর্জ ল্যামেটার। স্টিফেন হকিং শুধুমাত্র বিগ ব্যাং তত্ত্বের আধুনিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ল্যামেটার এই বিস্ফোরণের প্রাক মুহুর্তে আদিম পিন্ড কণাগুলোর নাম দিয়েছিলেন আদিম পরমাণু (primeval atom) । মূলত অত্যাধিক মহাকর্ষীয় সংকোচনের ফলস্বরূপ যে অসীম চাপ সৃষ্টি হয়, তার ফলেই ভ্রূণ মহাবিশ্বে ঘটে যায় সেই অকল্পনীয় বিস্ফোরণ। তৈরি হয় আমাদের এই বিস্তৃত মহাবিশ্ব। তার সাথেই সূত্রপাত ঘটে স্থান, কাল ও শক্তির। ধরা হয় সৃষ্টির এই মুহূর্তের আদি কালে স্থান, কালের কোনও ব্যাপার ছিল না। 

 

তবে বিস্ফোরণ বলতে আমরা সাধারণত যেটা বুঝি যে, হঠাৎ করে একটা বোমা ফেটে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার স্প্লিন্টার, বারুদ, বোমা বাঁধার উপকরণ ইত্যাদি। এটা কিন্তু একেবারেই সেরূপ ছিল না। সন্ধ্যাবেলা যে ফুলের কুঁড়ি থেকে ধীরে ধীরে পাপড়ি গুলো খুলে গিয়ে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে ফুলের আবির্ভাব ঘটে। এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আদিম পিন্ড থেকে মহাবিশ্বের বিস্তৃত বস্তু রাশি ও শক্তিসমূহ তার সময়কে সঙ্গে নিয়ে পরস্পরের থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। ভাবতেও কেমন অবাক লাগে। স্বপ্নেও যদি দেখা যেত সেই দৃশ্য। চক্ষু জোড়া সার্থক হতো। মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তু ও শক্তির নিরাকার আধারটি সবকিছু নিয়ে, নিজের থেকেই সবেগে সম্প্রসারিত হতে লেগেছিল। তাই অনেক গুণীজন একে বিস্ফোরণ না বলে মহাজাগতিক প্রস্ফুটন বা মহা স্ফীতি বলতে পছন্দ করেন।

শুরুতে মহাবিশ্ব কেমন ছিল?

এই তত্ত্ব অনুযায়ী আজ থেকে প্রায় ১ হাজার ৩৭৫ কোটি বছর পূর্বে এই মহাবিশ্ব একটি অতি ঘন এবং উত্তপ্ত অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। বিজ্ঞানী এডুইন হাবল প্রথম বলেন যে দূরবর্তী ছায়াপথসমূহের বেগ সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এরা পরষ্পর দূরে সরে যাচ্ছে অর্থাৎ মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের ফ্রিদমান-ল্যমেত্র্‌-রবার্টসন-ওয়াকার মেট্রিক অনুসারে এটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এবং তা প্রামাণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। শিশু মহাবিশ্ব শুরুর দিকে যতোই সম্প্রসারিত হচ্ছিল, তার তাপমাত্রা হ্রাস পাচ্ছিল। মহাবিশ্ব সৃষ্টির আদি ক্ষণে এর তাপমাত্রা প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডিগ্রী কেলভিন ছিল বলে অনুমান করা হয়। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমার ফলে ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াস স্থায়ী পরমাণু গঠন করতে শুরু করে। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই মুক্ত ইলেকট্রনের ঘাটতি দেখা দেয়। ফলস্বরূপ অস্বচ্ছ মায়াময়, ছায়া পরিবৃত মহাবিশ্ব স্বচ্ছ হয়ে যাওয়ার কারণে নানান বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। এই বিকিরণের বিচ্ছিন্নতার (Decoupling) কারণে বস্তু ক্রমে গ্যালাক্সি বা নক্ষত্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারলো। 

 আর আদিম সেই কসমিক ওয়েভ নিজের থেকেই বিজ্ঞানীদের সেই সময়কার অবস্থার প্রমাণ দিয়ে আসছে। যেন রহস্য উন্মোচনের ফিঙ্গার প্রিন্ট এই রেডিয়েশন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাব কিছুটা কম হলেও, মৃদু উপস্থিতি নিয়েই এই রেডিয়েশন বিজ্ঞানের সেবা করে চলেছে।

Copyright @ Soumen Chakraborty

Author

  • সৌমেন চক্রবর্তী

    লেখক সৌমেন চক্রবর্তী হাওড়া জেলার আমতা থানার কুমারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৩ সালের ৮-ই সেপ্টেম্বর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হবার পর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেন। এখানেই লেখকের জীবনে একটা নতুন দিশা উন্মুক্ত হয়। পদার্থবিজ্ঞানে এম. এস. সি. তে অপশনাল বিষয় হিসেবে ছিল জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান। মহাশূন্যের মহা স্রোতে উনি নিজেকে নতুন করে চেনেন। মহান বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্যে আসার সুবাদে বিজ্ঞান বিষয়ে আকর্ষণ দৃঢ় হয়। এমন সময় উনি কলকাতার বোস ইন্সটিটিউট্ থেকে গবেষণা করার সুযোগ পান। বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও সমান তালে চলেছে। লেখক বর্তমানে হাওড়ার গড় ভবানীপুর রামপ্রসন্ন বিদ্যানিকেতনে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত আছেন। সাহিত্যের সব আঙ্গিকেই সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়ে কবিতা, গল্প, নাটক, রম্যরচনা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই অবাধ বিচরণ।

    View all posts

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore