অণুগল্প “টিয়ে রঙের শাড়ি” লিখেছেন জেসমিন জাহান ঢাকা মিরপুর থেকে।

Story Artwork
অণুগল্প “টিয়ে রঙের শাড়ি” লিখেছেন জেসমিন জাহান ঢাকা মিরপুর থেকে। জেসমিনের ছোট্ট গল্পে ফুটে উঠেছে এক চির অভাগিনীর জীবন।

Share This Post

অণুগল্প “টিয়ে রঙের শাড়ি”

টিনের দোচালা ঘরটার সামনে বারোমাসি একটা সাজনা গাছ। গাছটাতে সাজনা যা ধরে, তা বিক্রি করে মজিরনের তেল নুনের খরচ অনেকটাই হয়ে যায়। গাছের ডালে একটা কাক নিঃশব্দে বসে আছে । তার দৃষ্টি গাছের নিচে রান্নাঘরের চালাটার ভিতরে মাংসের হাঁড়িতে। কোরবানির মাংস ভাগ হতে হতে প্রায় বিকেল হয়ে যায় এখানে। গ্রামের অর্ধেক মানুষেরই সামর্থ্য নেই কোরবানি দেয়ার। তারা এই ভাগের মাংসের জন্য হা করে থাকে।

সবেমাত্র সের খানেক মাংস ধুয়ে তুলে রেখেছে মজিরন। তেল, নুন আর হলুদ দিয়ে জ্বাল দিয়ে রাখবে। ছোট মেয়ে মিনা তার জামাইকে নিয়ে কখন এসে পড়ে! হয়তো কাল বিকেলেই আসবে। মেয়ে জামাইয়ের পাতে কী আর শুধু শাক-পাতা দেওয়া যায়! যে ভিক্ষে করে, সেও চায় একটু মাছ-মাংস জোগার করে রাখতে।

 

“ঐ যা! যা! দূর দূর”

 

হাতের কাছে সোলাগাছি নিয়েই দৌড়ে কুকুরটার পিছু গেল মজিরন। পাতি কাকটাও তক্কে তক্কে ছিলো। হাঁড়ি থেকে মাংসের একটা বড় টুকরো ছোঁ মেরে তুলে নিল। হঠাৎ কোথা থেকে হাজির আরেকটা কাক, মনে হয় ঐ কাকের জোড়া। ব্যাস। বেঁধে গেলো ঠোকাঠোকি। আর যায় কোথায়। মাংসের টুকরোটাই নিচে পড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে টুকরোটা তুলে নিয়ে ভাল করে ধুয়ে হাঁড়িতে রেখে ঢাকনা দিয়ে তাড়াতাড়ি চুলায় বসিয়ে দিল মজিরন।

 

“যাক বাবা নিতে পারেনি মাংসের টুকরোটা!”, মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। এই একটুকরো মাংস আর একটু ঝোল হলে তার এক থালা ভাত খাওয়া হয়ে যায়। সারাটা বছর এই দিনটার অপেক্ষায় থাকে তার মতো অনেকেই। মাংস কিনে খাওয়ার সামর্থ্য কোথায়? একবেলা নুন ভাত জোটাতেই সড়কে মাটি কাটার কাজ করতে হয়। অন্য সময় মানুষের বাড়িতে খুচরো মজুরের কাজ করে। এক হাত ভাঙ্গা। ভাঙ্গা হাত নিয়ে কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কাজ না করলে খাবে কী?

রান্না করতে করতে ভাবনার জগতে হারিয়ে যায় মজিরন। দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে বিধবা হয়েছিলো সেই বিশ বছর আগে। তখন বড় ছেলে নিজামুদ্দির বয়স ছিল পনের। ছোট ছেলে মইনুদ্দির তের। আর মেয়ে বীনার বয়স দশ। সে বছরই বন্যায় ভিটেবাড়ি ভেঙ্গে নদীতে চলে গেলো। এমনকি বীনার বাবাকে যেখানে কবর দেয়া হয়েছিল সেই কবরস্থানটাও নদীর পানিতে তলিয়ে গেলো। এর তার বাড়ি কাজ করে অনেকদিন চলেছে মজিরনের। চলেছে বলাটা ভুল হবে। চালিয়ে নিতে হয়েছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছিলো। কিন্তু এরই মধ্যে বাঁধ সাধলো তার শরীর। এমনিতে সুন্দরী তাকে বলা যায় না! কোথায় যেনো একটু কমনীয়তা লুকিয়ে আছে। আর আছে পরিশ্রম করার প্রবল মনোবল। অনেকেরই লোভাতুর চোখ তার দিকে ঘুরে ফিরে যেতে থাকে, বুঝতে পারে সে। যাদের বাড়ির খালি ভিটাতে ঘর বেঁধে থাকছিলো এতোদিন, সেই ফেরেশতার মতো মানুষটাও মজিরনকে একা পেলে যে কতো ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তা সে বুঝিয়ে দিয়েছে কিছুদিন আগে। তার নজর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সবসময় গুটিশুটি মেরে থাকতে আর ভালো লাগছিলো না মজিরনের। মানুষ কী এভাবে বাঁচে!

 

তিনটা ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছিল যখন, ঠিক তখনই হঠাৎ করেই ঢাকা থেকে গ্রামে আসা তার চাচাতো ভাই মীরআলী তাকে এই অন্ধকারে আলোর পথ দেখায়। মীর আলী ছোট বেলা থেকেই ঢাকায় কাজ করে। যখন যে কাজ পেতো সে কাজই করতো এতোদিন। এখন নিজের একটা দোকান হয়েছে। পুরনো মালামাল বিক্রির দোকান। ভালোই আয় হয়। বিয়েও করেছিলো একটা; কিন্তু বউটা বাচ্চা হতে গিয়ে মারা যায়। বাচ্চাটাও বাঁচেনি। তারপর থেকে একাই আছে। খায়-দায় আর বন্ধু বান্ধবের পিছনে টাকা খরচ করে দু’হাতে। 

 

মীর আলী কয়েকদিন গ্রামে ছিলো। এরই মধ্যে একদিন হঠাৎ সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে সে মজিরনকে। একটু থমকে যায় মজিরন। সে ভাবে, এখন বিয়ে করলে লোকে কী বলবে! আবার এও চিন্তা করে বাচ্চাগুলো নিয়ে না খেয়ে থাকলে তো লোকে দেখবে না। মীর আলী তাকে ঢাকা নিয়ে যাবে। সেখানে ছেলে দুটোকেও একটা কাজে পলাগিয়ে দিতে পারবে। চিন্তা করে কূল কিনারা করতে পারে না সে। একদিন সময় দিয়েছে মীর আলী তাকে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য। যুবতী বিধবার যে অভিজ্ঞতা তার হয়েছে, তাতে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে, আর এভাবে থাকবে না সে!

 

রাত তখন ১০ টা বাজে, মজিরন গিয়ে উপস্থিত হলো মীর আলীর ফুপুর বাড়ির উঠোনে। ফুপু আর ফুপাতো ভাইয়ের সাথে গল্প করছিলো সে, মজিরনকে দেখে উঠে এলো,

 

“কী সিদ্ধান্ত নিলা, মজু।” 

লজ্জা পেয়ে যায় মজিরন। বলে, “আমি তোমার সাথে ঢাকায় যামু ভাইজান।”

“ঢাকায় তো যাইবা তয় বিয়ার আগে না পরে?”

“পরে”, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে সে।

কখন যে মীর আলীর ফুপু এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি ওরা। ফুপুর কথায় নিরবতা ভাঙলো তাদের।

“এতদিনে একটা ভাল সিদ্ধান্ত নিলি, মজিরন।”

তক্ষুনি কাজি ডেকে বিয়ে পড়ানো হলো তাদের। সকালে মজিরন তার ছেলে-মেয়ে নিয়ে স্বামীর সাথে ঢাকা চলে গেলো। তারপর সুখেই ছিলো তিনটি বছর। এমন সুখের সময় তার আগে কোনদিন আসেনি। দুইটা ছেলেই মোটর মেকানিকের কাজ শিখে ফেলল। ওয়ার্কশপে কাজ করে টাকা জমায়। মীর আলী কিছুই বলে না, দিলদরিয়া মানুষ সে। মেয়েকে ১৩ বছর বয়সেই বিয়ে দিলো মজিরন। তার ভাইয়ের ছেলের সাথে। তার ভাইটা মুন্সীগঞ্জে ঠিকাদারির কাজ করত। সেখানেই বাড়ি করে থিতু হয়েছে। ভাই আগ্রহ করেই বীনাকে তার ছেলের বউ করতে চেয়েছে। তারপর সবাই মিলে গ্রামে এসে ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিলো। বিয়ের মাস তিনেক পরে এক সকালে মীর আলিকে নিয়ে ঢাকা থেকে রওয়ানা হলো মজিরন তার মেয়েকে দেখার জন্য। রাস্তা ফাঁকা থাকাতে খুব দ্রুত চলছিলো গাড়ি। আর মাত্র ২০ মিনিট পর গাড়ি থেকে নামবে তারা, এমন সময় কী যে হলো! বিকট আওয়াজ করে গাড়িটা  গড়িয়ে পড়লো রাস্তা থেকে নিচে। তারপরে আর কিছু মনে নেই তার। যখন জ্ঞান ফিরল নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় দেখতে পেলো সে। হাতে মাথায় ব্যান্ডেজ। হাতটা ভেঙ্গে গেছে, চোট লেগেছে মাথায় আর ঘাড়ে। মীর আলিকে না দেখতে না পেয়ে মজিরন নার্সকে জিজ্ঞেস করলো। সেও কিছু বলতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে তার ভাই এল। ভাইকে দেখে মজিরনের মনে সাহস আসে একটু।

“ভাইজান, তোমাগো জামাই যে কই আছে আমি তো কিছুই জানিনা, একটু খোঁজ নেও।” 

ভাই তো সেই খবর নিয়েই এসেছেন। তাই বললেন,

“তর আবার কপাল পুড়ছে রে বইন। মীর আলী আর নাই।”

 

আবার শুরু হলো জীবন-যুদ্ধ। সে তখন পাঁচ মাসের পোয়াতি। তাই কিছুদিনের মধ্যেই সাথে যোগ হয়েছে আরও একটা মুখ। কেটে গেল আরো কয়েকটা বছর। কীভাবে এতটা বছর কাটিয়ে দিলো তা শুধু সে নিজেই জানে। খেয়ে না খেয়ে মেয়েটাকে বড় করেছে। ছেলেরা ধীরে ধীরে যে যার পথ দেখেছে। অন্যের মেয়েকে তারা মানুষ করবেই বা কেন? তবে শেষ পর্যন্ত ছোট মেয়ে মিনার বিয়েটাও দিয়েছে সে। ছোট মেয়েটা  মাঝে মাঝে মাকে দেখতে আসে। জামাইটাও ভালো। মেয়ে তার সুখেই আছে। এখন নিজে কষ্টে থাকলেও ছেলে-মেয়েরা ভালো আছে একথা ভাবতে তার ভালোই লাগে।

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মজিরন আনমনা হয়ে পড়েছিল খানিকটা। এদিকে চুলার আগুন নিভে গেছে বুঝতেই পারেনি। বর্ষার এই সময়টাতে আগুন জ্বালানো খুব কঠিন। দেশলাইয়ের বারুদ নেতিয়ে থাকে সহজে আগুন ধরে না। তার ওপর আবার শুকনো পাতা কিংবা পাটকাঠিও নেই। অনেক কষ্টে আবার আগুন ধরায় সে। আকাশে অনেক মেঘ। আবহাওয়ার অবস্থাও ভালো না। গরম পড়েছে খুব। পানি বাড়ছে চারদিকে। বিকেল নাগাদ উঠোনে চলে আসতে পারে পানি। এ অবস্থায় মেয়েটা নৌকায় করে আসবে। কি জানি কী বিপদ হয়। নৌকায় তাড়াতাড়ি আসা যায়। ভাড়াও কম। তাই অনেকেই আড়াআড়ি পথে নৌকায় আসা-যাওয়া করে। কিন্তু মনটা কেমন করে ওঠে তার। কোনমতে রাতটা কাটে। সকাল থেকে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকে মজিরন।  আকাশ কালো হয়ে আছে। থেকে থেকে বৃষ্টি পড়ছে। মনে তার কু ডাকে। হঠাৎ কী যে হল, নিজেও বুঝতে পারছে না। জোহরের নামাজ পড়ে সবেমাত্র জলচৌকিতে একটু শুয়েছিলো। এরই মধ্যে বাইরে মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে আসে। দেখল, দৌড়াতে দৌড়াতে গাঁয়ের মানুষ নদী ঘাটের দিকে যাচ্ছে। নশু পাগলা চেঁচাচ্ছে,

“কে, কই আছো গো? তাড়াতাড়ি আইসো, নাও ডুবছে গো! নাও ডুবছে! আহারে মানুষগুলানরে বুঝি আর বাঁচানো গেলো না!”

 

দৌড়াতে থাকে মজিরনও। তার বাড়ি থেকে নদীর ঘাট হেঁটে গেলে দশ মিনিটের পথ। উর্ধ্বশ্বাসে সেখানে পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যায় সে। নদীর ঘাটে সারি সারি লাশ। লাশের সারিতে টিয়ে রঙের শাড়ি পড়া একটি মেয়েকে দেখে, বুকফাটা আর্তনাদ করে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় মজিরন। টিয়ে রঙের শাড়িটা খুব প্রিয় ছিলো মিনার।

Author

  • জেসমিন জাহান

    জেসমিন জাহান: জন্ম ঢাকা মিরপুরে, ২৯ অক্টোবর, ১৯৭৫ সাল । পড়াশুনা ঢাকাতেই। এম.এ (বাংলা), এম.এড। উনি একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ ও সম্পাদিত গ্রন্থ সব মিলিয়ে ৭ টি বই লিখেছেন। 'সাহিত্য স্পন্দন' নামে একটি মাসিক পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক। লেখালেখির জন্য বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন। উনি স্বপ্ন দেখেন, বিভেদ ও কলুষ মুক্ত সুন্দর এক পৃথিবীর।

    View all posts

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore