ছোট্ট একটা বাংলা ভৌতিক গল্প: “বার্ষভানবী” লিখেছেন কলকাতা থেকে চৈতালী সিংহ রায়।

Artwork
বার্ষভানবী একটা ছোট ভৌতিক গল্প যার মুখ্য চরিত্রে একজন রূপান্তরকামী পুরুষ। কলকাতা থেকে লিখেছেন চৈতালী সিংহ রায়।

Share This Post

ভৌতিক ছোট গল্প: বার্ষভানবী

সেদিন ভরতপুর স্টেশনে পা রাখার সাথে সাথেই  আকাশে এক টুকরো ঘন কালো মেঘের ভেলা দেখে মনটা বিচলিত হয়ে উঠলো। নিজের মনে মনেই বলে উঠলাম, নাহ আর দেরি করা চলবে না। তাড়াতাড়ি পা চালাতে হবে। আকাশের অবস্থা ভালো নয় দেখছি।

এদিকে একটা গাড়ি, টাঙা, অথবা রিক্সা কিছুই  দেখতে পাচ্ছি না।

কত বছর পর এলাম এই পথে। সেই শেষবার এসেছিলাম মাসির মৃত্যুর সময়। কিন্তু এই চত্বরটা তো এখনও একরকমই দেখছি। কিছুই পরিবর্তন হয়নি।

এতোটা পথ, হেঁটে যেতে যেতে মাঝপথে  আকাশ ভেঙে পড়লেই গেলো।

ও এই দেখুন এতক্ষন তো আমার নিজের পরিচয় টাই দেওয়া হয়নি, আমি ঋক। ঋক সাহা। বহুবছর পর গিয়েছিলাম মাসির বাড়ি। বর্তমানে মাসি না থাকলেও মেসো, দাদা, বৌদিরা, তাদের বাচ্চারা সকলেই আছে।

মাঝে বেশকিছুদিন মাসি মারা যাওয়ার পর যোগাযোগ ছিলনা  কারোর সাথেই। কিন্তু এই ফেসবুকের যুগে আবার নতুন করে সবার সাথে যোগাযোগ হয়।

তারপর থেকেই মেসো আমাকে একবার দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। দাদারাও বললো, “বাবার শরীর খুব একটা ভালো নেই, কবে কি হয়ে যায় তুই একবার এসে ঘুরে যা।” 

আমিও একা মানুষ বেড়িয়ে পড়লাম। মা চলে যাবার পর পিছুটান বলতে আমার কিছুই নেই। তাই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে টুক করে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এদিকে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেও  গাড়ির অস্তিত্ব তো দূরে থাক একটা জনমানব ও চোখে পড়ছিল না । অগত্যা  হাঁটার পথই ধরলাম  বাধ্য হয়ে। মিনিট খানেক হাঁটার পরেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমে এল।  অসময়ের বৃষ্টি ভিজলেই নির্ঘাত শরীর খারাপ হবে,  ভাবতে ভাবতেই  সামনে পথের ডান পাশে একটা দোকানের অবয়ব দেখতে পেলাম। মনের ভিতরে বেশ একটা আনন্দের ঢেউ খেলে গেল এই অসময়ে, দুর্যোগ, অজানা জায়গায়। যাই হোক বাবা একটা মাথা গোঁজার আশ্রয় তো পেলাম।

ভৌতিক বাড়ি

এক ছুটে গিয়ে ঢুকলাম দোকানের ভিতরে। কিন্তু এদিকে বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। টিনের ফুটো চাল দিয়ে টপ, টপ, টপ, করে বৃষ্টির জল পড়ছে একটা বালতির উপর। এক চিলতে দোকান ঘরটার চাল ফুটো হলেও বেশ  সুন্দর করে সাজানো গোছানো। ভ একমনে উপভোগ করছিলাম বালতির উপরে বৃষ্টির জল পড়ার শব্দ। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলাম দোকানের মালিকের কণ্ঠস্বরে,

“কি স্যার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?”

ওর প্রশ্ন শুনে উত্তরে হাসতে হাসতে বলে উঠলাম,

“আরে না না অসুবিধা কি বলছো, দুই পাশের এই শাল পাতার জঙ্গলের মাঝে যে তোমার আশ্রয় পেলাম এই দুর্যোগের সময় এইটাই বিশাল বড় ব্যাপার। না হলে ভিজতে হত। আর এই অকাল বর্ষণে ভিজে মাসির বাড়ি মাসতুতো দাদার ডাকে ঘুরতে আসার আনন্দের স্মৃতির পরিবর্তে নিমোনিয়া উপহার নিয়ে ফিরতাম। “

আমার উত্তর শুনে সেও হেসে উঠলো।

“তুমি কি একাই এখানে থাকো?”

“হ্যা”…

“এই জঙ্গলে একা  থাকতে ভয় লাগেনা?”

“না। অভ্যাস হয়ে গেছে। প্রকৃতিই আমার সঙ্গী।  নির্জনতা আমার আত্মা। কোলাহল আমার বড় অপছন্দের।”

“বাব্বা তুমি বেশ কথা বলোতো! ওই দেখো তোমার নামটাই জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি ….”

“বার্ষভানবী।”

নামটা প্রথমবার শোনার পরেই আমার মস্তিষ্কে একটা কাঁটা খচখচ করছিলো। যতদূর জানি বার্ষভানবী রাধার আর এক নাম। কিন্তু একজন পুরুষ মানুষের  এই নারীর নাম বহন করে চলার কারণ কি?

তবে এখানে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই  লক্ষ্য করছি আশ্রয়দাতা মানুষটির আচরণ একটু অন্যরকম। শরীরে পুরুষালী গঠন হলেও চলাফেরায়  কাজকর্মে নারী সুলভ ভাবভঙ্গি বেশ স্পষ্ট।

আমার মাথায় নানারকম প্রশ্ন ঘুরতে থাকলেও অহেতুক  প্রশ্ন করা উচিত নয় ভেবে চুপ করে আছি। 

কিন্তু সামনের মানুষটা যেন বিপরীতের মানুষটার মস্তিস্কের গতিপথ  অনুভব করতে পারে। সে  যেন এক মুহুর্তে পড়ে ফেললো আমার ভিতরের কথা। নিজের থেকেই বলে উঠলো,

“আমি রূপান্তরকামী এক পুরুষ। নিজেকে নারী রূপে কল্পনা করতে। নারী রূপে পরিবেশন করতে বেশি ভালোবাসি। স্বাচ্ছন্দ অনুভব করি। তাই যেদিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিলাম, বাবা সবাইকে সাক্ষী রেখে আমাকে ত্যাগ করেছিল। মাও হাতটা চেপে ধরে বলেনি, ‘সোনা তুই তো আমার সৃষ্টি। আমার অঙ্গ।’ সেইদিন বাবা মায়ের দেওয়া নামটাও ছেড়ে এসেছিলাম চিরতরে। “

আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা। কেমন যেন একটা ঘোরে আছি। হঠাৎ করে বাইরের মতনই ঘরের ভিতরের বাতাসটাও কেমন যেন ভারী হয়ে উঠেছে।

খুব কাছাকাছিই জোরে বাজ পড়বার শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলাম আবার। ঘরের আবহাওয়া কে হাল্কা করতে বলে উঠলাম, “আমি যতক্ষন তোমার সঙ্গী হলাম অতো বড় নামে ডাকতে পারবনা তোমাকে। আমি না হয় বর্ষা বলেই ডাকি তোমাকে।”

আমার কথায় সামনের চোখ দুটো যেন চিকচিক করে উঠলো। ফিরতি উপহার হিসাবে পেলাম একগাল হাসি। রাত বাড়ছে। বাইরের প্রকৃতি ক্রমশ আরও অশান্ত হয়ে উঠছে। এদিকে আমাদের দুজনের বন্ধুত্ব খুব জমে উঠেছে।

পাহাড়ি রসুনের চাটনির সহযোগে আলু পরোঠা, আর চা দিয়ে রাতের খাবার শেষ করলাম। এ যেন আমার কাছে অকাল বর্ষণ। স্টেশনে নেমে আশ্রয় কোথায় পাবো বুঝতে পারছিলাম না, কি করবো ভাবতে পারছিলাম না সেখানে আশ্রয়ের সাথে সাথে এইরকম সুস্বাদু গরম গরম খাবার পাবো কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি।

খাবার শেষে গিটারে গান ধরলো বার্ষভানবী, “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল  করেছ দান…..আমি দিতে এসেছি  শ্রাবণের গান।….”

একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুর তুলে চলেছে। একপাশের দেওয়ালে লাগানো  কুক্কু ঘড়ির ভিতর থেকে সুন্দর একটা পাখি বাইরে বেরিয়ে জানান দিয়ে গেল রাত একটা বাজে। ঠিক করেছি আজকের রাতটা আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দেব দুজনে।

একটা কথা অনেকক্ষণ থেকেই ভাবছি। জিজ্ঞাসা করতে পারছিলাম না। শেষে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম।

“বর্ষা, কোনদিন ভালোবাসতে ঘর বাঁধতে ইচ্ছা করেনি কারোর সাথে? না, মানে অনেকেই তো আছে তোমাদের মতনই রূপান্তরকামী নারী পুরুষ, তারা সংসার করছে। কিছু মনে কোরোনা আবার। “

আমার প্রশ্নের উত্তরে মুখে একটা মলিন হাসি ঝুলিয়ে বলতে শুরু করল,

“ঘর বাঁধার,একসাথে পথচলার স্বপ্ন চোখে নিয়েই আমি আর তনয় পথে বেরিয়ে পরেছিলাম। এইযে ঘরটা দেখছো নিজেদের হাতে বানিয়েছিলাম। এই ঘরের প্রতিটা দেওয়াল তনয় নিজের হাতের কাজে সাজিয়ে তুলেছিল।”

“তনয় কোথায়? ওকে দেখতে পাচ্ছি না তো।”

আমার প্রশ্নটা যেন শুনতেই পেলনা, সে আপন মনে বলেই চললো, “এইতো কয়েকবছর আগের কথা বাড়ি ছাড়ার পর আমি আর তনয় ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে একটু মাথা গোঁজার আশ্রয় খুঁজছি নতুন জীবন শুরু করবো বলে, কিন্তু কোথাও একটু আশ্রয় পাচ্ছিলাম না। শেষে এই অঞ্চলে আসি। এই বাড়িটা ছিলো লেসিকা আন্টির। শরীর বার্ধক্যে দুর্বল করে দিলেও কঠিন মানসিকতাপূর্ন সেই বৃদ্ধা মহিলা আমাদের কাছে টেনে নেন। ধিরে ধিরে আশেপাশের সবার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় আমাদের। আমাদের  জীবনযাপন নিয়ে কোন অস্বাভাবিকতা এই সহজ সরল মানুষদের মনে কোন প্রশ্নের সৃষ্টি করেনি কোনদিন। বেশ আনন্দেই কেটে যাচ্ছিলো সময়।

কিন্তু ওই যে সুখের স্থায়িত্ব যে বড় কম। আমাদের জীবনেও ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। লেসিকা আন্টির বচসা বাঁধলো সেইসময়ের এই শালপাতার জঙ্গলের ঠিকাদারদের সাথে। রাত্রের অন্ধকারে গাছ কেটে পাচার করে দিচ্ছিল তারা। সেই অশান্তি চলতে চলতে চরম পর্যায় গিয়ে পৌঁছায়। সেইদিনও ছিলো এইরকম এক ঝড় জলের রাত। এত অশান্তি লেসিকা আন্টির শরীর নিতে পারলনা। ছেড়ে চলে গেলেন তিনি আমাদের।

তখন গভীর রাত, জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমি আর তনয় বসে ছিলাম লেসিকা আন্টির দেহ ধরে ভোরের সূর্য ওঠার অপেক্ষায়। হঠাৎ নাকে এলো কেরাসিন তেলের তীব্র গন্ধ। কিছু বুঝে উঠবার আগেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো চারপাশ। আমি আর তনয় তখন ছোটাছুটি করছি ঘরের ভিতরে  আগুন নেভাবার জন্য। যখন বুঝলাম পারবো না নেভাতে তখন দুইজনে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম সেই জতুগৃহ থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু সেই শয়তান গুলো চারপাশ বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা লেসিকা অ্যান্টির শোকে এতটাই বিহ্বল হয়ে ছিলাম যে টের পর্যন্ত পাইনি।”

Burning House Artwork

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম …..” তার মানে?”

আমার মস্তিষ্ক যেন হঠাৎ করেই  কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে ওর কথাবার্তা শুনে। মনের ভিতরে এক অশনি সঙ্কেত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। অজানা এক ভয় আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে আমাকে। আমার ভিতর থেকে কে যেন প্রশ্ন করে উঠছে বারেবারে, “তবে কি…………।”

ঠিক তখনই একটা শীতল হাওয়া যেন  বয়ে গেল আমার শরীরের উপর দিয়ে। নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলাম। এদিকে  বার্ষভানবী  বলেই চলছে নিজের কথা। আমার কোন কথাই সে শুনতে পাচ্ছে না। আমার মুখে চোখে যে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে  কিছুই যেন তার চোখে পড়ছে না।

“শেষে আমি আর তনয় লেসিকা আন্টির দেহ জড়িয়ে ধরে নিজেদের মুক্ত করলাম। ত্যাগ করলাম এই সংসারের মায়া। কিন্তু লেসিকা আন্টি, তনয় নিজেদের এই জগত থেকে মুক্ত করতে পারলেও আমি পারলাম না। আমার যে অনেক সাধ ছিল মনে। একটা অনাথ আশ্রম থেকে মেয়ে দত্তক নিয়ে তার মা হয়ে উঠে তাকে মানুষ করার সব ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু ওই শয়তান গুলোর জন্য আমার সব স্বপ্ন অপূর্ন রয়ে গেল। আমি এইরকম প্রতি ঝড় জলের রাত্রে তাই খুঁজে বেড়াই আমার সেই হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন গুলো।”

এইবার বার্ষভানবী একটু থেমে, আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তো আর জীবিত নই। তবে তোমার দেওয়া নাম বর্ষা আমার পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তুমি জানো? তোমাকে দেখতে পুরো আমার তনয়ের মতন। ওই দেখো দেওয়ালে টাঙানো ছবিতে আমি তনয় আর লেসিকা আন্টি।”

ঘরের মৃদু আলোয় আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল দেওয়ালে টাঙানো একটা ফটোফ্রেম। যার ওপর একজন বয়স্ক মহিলার সাথে বার্ষভানবী আর আমি নিজে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ করেই যেন ঘরে একটা হাড় হিম করা শীতল হাওয়া বয়ে গেল। তারপর সব অন্ধকার।

পরেরদিন আমি নিজেকে খুঁজে পেয়ে ছিলাম স্থানীয় হাসপাতালের বিছানায়। জঙ্গলের শ্রমিকরা পথের ধারে আমাকে পড়ে থাকতে দেখে প্রথমে মৃত ভাবলেও কাছে এসে যখন দেখে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চলছে তখন হাসপাতালে নিয়ে যায়।

আমার জ্ঞান ফিরতে আমার থেকে ঠিকানা নিয়ে  দাদাদের মেসোদের খবর দেওয়া হল। শেষে চারদিনের জ্বর কাটিয়ে সুস্থ হলাম। সবাই ঘটনা শুনে বলতে  লাগলো এই যাত্রা খুব জোর বেঁচে গিয়েছি। কিন্তু কোন কথাই যেন  আমাকে আর স্পর্শ করছিলো না। আমার ভাবনা জুড়ে তখন শুধু বার্ষভানবী। নাকি বর্ষা?

মনের মধ্যে আবছা হয়ে ভেসে উঠছিল শুধুই , দেওয়ালে টাঙানো সেই ছবি।

আজও মনের ভিতরে প্রশ্ন ঘোরে,

‘তবে কি সত্যিই আমি?’

© চৈতালী সিংহ রায়

Author

  • চৈতালী সিংহ রায়

    জন্ম উত্তর কলকাতার পাথুরিয়া ঘাটার সিংহভিলা বাড়িতে। উনি নিয়মিত বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিক এবং ম্যাগাজিনে লেখেন। সুলেখিকা, সুগৃহিনী, দায়িত্বশীল মা এবং সমাজসেবী।

    View all posts

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore