কলকাতার নামকরা স্কুলে আবার কর্পোরাল পানিশমেন্ট, কি বলছেন নেটিজেনরা?

corporal punishment in school
এবার শিরোনামে দক্ষিন কলকাতার যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুল। অভিযোগ যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলের এক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। হোম ওয়ার্ক না করে আনার অপরাধে ক্লাস ফাইভ এর বাচ্চাকে তিনি এমন শাস্তি দিয়েছেন যে তার সারা গায়ে কালশিটে দাগ।

Share This Post

এবার শিরোনামে দক্ষিন কলকাতার যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুল। অভিযোগ যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলের এক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। হোম ওয়ার্ক না করে আনার অপরাধে ক্লাস ফাইভ এর বাচ্চাকে তিনি এমন শাস্তি দিয়েছেন যে তার সারা গায়ে কালশিটে দাগ। ফলে শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত বাচ্চাটাকে নিয়ে বাবা মাকে ছুটতে হয় ডাক্তারখানায়। তারপর তারা অভিযোগ দায়ের করেন লেক থানায়। পরে অবশ্য ওই শিক্ষিকা বাচ্চাটার বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে স্কুল কর্তৃপক্ষ অবশ্য স্বীকার করেছেন যে এই ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তার থেকেও দুর্ভাগ্যজনক হল, এই খবরের পরিপ্রেক্ষিতে নেটিজেনদের মন্তব্য।

comments of netizens on corporal punishment

কি বলছেন নেটিজেনরা এই খবরে?

এই খবরে বেশিরভাগ নেটিজেন যে মন্তব্য করেছেন তা কিন্তু বেশ উদ্বেগ জনক। বেশিরভাগের মন্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে কর্পোরাল পানিশমেন্ট বা শারীরিক শাস্তি এক ধরনের অপরাধ, এই বোধটাই আমাদের সমাজে এখনো তৈরি হয়নি। কেউ বলছেন, “এ তো আমাদের কাছে জল ভাত, আমরা বেত্রাঘাত থেকে শুরু করে, কানমলা, নীলডাউন, পেন্সিল দিয়ে আঙুল পেঁচানো, নানা রকম শাস্তি পেয়েছি।”

একজন মন্তব্য করেছেন, শিক্ষিকার কোন দোষ নেই। দোষ সম্পূর্ণ ওই ছাত্রের গার্জিয়ানদের। কারণ গার্জিয়ানরা বাচ্চাকে হোমওয়ার্ক করানোর দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। একজন আবার এক কদম এগিয়ে বলেছেন, কর্পোরাল পানিশমেন্ট তুলে দেওয়াই উচিত নয়। বরং শিক্ষকদের হাতে বেত ফিরিয়ে দিলে তবেই সমাজের উন্নতি হবে। আবার একজন নেটিজেন দাবি করেছেন আচ্ছা করে পেটালে কেউ কোনদিন আমব্রেলা বানান ভুল বলতো না। অন্য একজনের দাবি, রামকৃষ্ণ মিশনে বেধড়ক পেটানো হয় বলেই নাকি তাদের সব ছাত্র ফার্স্ট ডিভিশন পায়। মোদ্দা কথা, নেটিজেনদের বেশিরভাগেরই বক্তব্য, বেশ করেছে মেরেছে। ছাত্রদের মাস্টার মশাই কিংবা দিদিমণিরা যেমন খুশি মারবে, যেমন ভাবে ইচ্ছা মারবে এবং যেভাবে ইচ্ছা মারবে। এতেই নাকি সব ছাত্ররা মানুষের মতন মানুষ তৈরি হবে।

কেন এমন বিপুলসংখ্যক নেটিজেন কর্পোরাল পানিশমেন্ট এর পক্ষে মন্তব্য করছেন?

কর্পোরাল পানিশমেন্ট শুনতে যতই গাল ভরা লাগুক আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে শারীরিকভাবে আঘাত করে শাস্তি দেওয়া। মারধর করে শাস্তি দেওয়া। আমাদের সমাজে চলতি নিয়ম অনুযায়ী আমরা ধরেনি, এক শ্রেণীর মানুষের আরেক শ্রেণীর মানুষকে মারার অধিকার আছে। যেমন শিক্ষক ছাত্রকে মারতে পারবে। পুলিশ চোরকে মারতে পারবে। বাবা, মা, ছেলে মেয়েকে মারতে পারবে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজ এক শ্রেণীর মানুষকে, আরেক শ্রেণীকে মারতে পারার ন্যায্য অধিকার দিয়ে এসেছে। আমাদের একটা ধারণা আছে যে এতে ভালো হবে বা হয়। ফলে এই মারামারির অধিকার বা ন্যায্যতা ছড়িয়েছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই ন্যায্যভাবে মারামারির শিকড় কিন্তু শুধু গার্জেন, শিক্ষক বা পুলিশের মধ্যেই সীমিত নেই। আমাদের সমাজে পুরুষ সিংহ স্বামী, পাড়ার দাদা থেকে শুরু করে, সিনেমার হিরো প্রায় সকলেই বল প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যায্য শাস্তি দিয়ে থাকেন।  

কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা, মারা। আরো ভালো ভাবে বললে, বেধড়ক মারা আমাদের সমাজের মানুষের জিনে ঢুকে পড়েছে। রিক্সাওয়ালা প্যান্টে কাদা লাগিয়ে দিয়েছে, “তবেরে অমুকের বাচ্চা, দমাস্।”

বাইকের সাথে ওলার ঘষাঘষি, “বাইক থেকে বাহুবলী নেমে দমাস্ দমাস্। যেন সাউথ ইন্ডিয়ান ফিল্মের শুটিং হচ্ছে।” এই যে কদিন আগে ভোট হল। চারিদিকে আমরা দেখেছি, কেউ না কেউ, কাউকে না কাউকে মেরেছে। কে কাকে মেরেছে এটা বড় কথা নয়। মারামারির ট্র্যাডিশনটা চলছে চলবে। সুতরাং একথা স্বীকার করতেই হয়, স্কুলে কর্পোরাল পানিশমেন্টের পক্ষে নেটিজেনদের এই সমর্থন সামগ্রিক ভাবে আমাদের মানসিকতার প্রতিফলন।

netizens comment in favour of corporal punishment at jodhpurpark boys school kolkata

উল্লেখযোগ্য বিষয় প্রায় সব মারামারির ক্ষেত্রেই যে পক্ষ মারে সে পক্ষের একটা যুক্তি থাকে। যে যুক্তিগুলো দিয়ে তারা দাবি করে যে মারা উচিত হয়েছে। যেমন চোর ধরা পড়লে মারা। কেন চোর পেটানো উচিত? সে নিয়ে যুক্তির কোন অভাব নেই। এক সপ্তাহে চার দিন পায়খানার মগ চুরি করে নিয়ে গেছে। পাতাখোরকে না ক্যালালে সে শুধরাবে না। পুলিশে দিয়ে কোন লাভ নেই, বিচার ব্যবস্থায় কোন আস্থা নেই। সুতরাং মারের পক্ষেই দল ভারী। মারা যেতে পারে এবং মারা উচিত।

শুনতে যতই খারাপ লাগুক, মারার যৌক্তিকতা আমরা প্রথম শিখি আমাদের বাবা-মায়ের কাছে। বাবা মায়েরা যখন প্রথম ছেলে মেয়েদের মারেন, তখনই তারা শিখে যায় যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে একটা মানুষ আর একটা মানুষকে মারতে পারে। আর এই মনোভাব সামগ্রিকভাবে আমাদের জীবনে এবং সমাজে প্রতিফলিত হয়। তাই যতই ভারতীয় দণ্ডবিধিতে লেখা থাকুক, আমাদের এটা হজম করতে খুব কষ্ট হয়, যে, যেকোনো পরিস্থিতিতেই একজন মানুষের আরেকজন মানুষকে স্বেচ্ছায় আঘাত করা আইনত অপরাধ। জেনে রাখা ভালো, কোন উন্নত এবং সভ্য দেশেই কর্পোরাল পানিশমেন্ট এর চল নেই।

Author

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore