কী করে লিখতে হয় অণুগল্প?

How to write a story banner
নতুন লেখকেরা অনেকেই মনে করেন অণুগল্প ছোট মানেই তা লেখা সহজ। এমন মোটেও নয়। ছোট করে লেখা গল্প হলেই অণুগল্প হবে না। তাকে হতে হবে রসোত্তীর্ণ। তাতে থাকতে হবে যে কোনও গল্পের সমস্ত বৈশিষ্ট্য।

Share This Post

অণুগল্পের কি আদৌ আছে নিজস্ব কোনও বৈশিষ্ট্য?

অণুগল্পের অনেক নাম দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ফ্ল্যাশ ফিকশন, মাইক্রো ফিকশন, ন্যানো ফিকশন, সুপার শর্ট ফিকশন, পোস্টকার্ড ফিকশন, শর্ট শর্ট, ড্রাবল (Drabble), ড্রিবল (Dribble), মিনিসাগাজ (Minisagas), টুইটারে লেখা অণুগল্পের নাম টুইটারেচার (Twiterature) বা টুইকশন (Twiction) ইত্যাদি।  

সাহিত্যের এই ধারাটিকে অপেক্ষাকৃত নতুন বলা হলেও লোকগল্প, লোককথা, ধাঁধা, সদুপদেশের গল্প (যেমন ঈশপের গল্প), ফেবল (কথা রূপক), প্যারাবল (উপরূপক), ধর্মীয় গল্প-উপদেশ, এমনকি রূপকথার মধ্যেও (গ্রিম ভাইদের রূপকথা) অণুগল্পের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। চার্লস বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৯) উনিশ শতকে ছোট পরিসরে লেখা চালু করেন যার নাম তিনি দেন ‘prose poetry’। তাঁর প্রোজ পোয়েট্রি সংকলনের নাম ‘Paris Spleen’ (1869)। সেগুলিকেও অণুগল্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেক সমালোচক। তবে সাহিত্যের সব শাখার মতোই অণুগল্পর স্বরূপ নির্ণয় করা খুবই শক্ত।

অণুগল্পর শব্দ সংখ্যা নিয়েও নানান মত। অনেকে এক হাজার শব্দের গল্পকেও অণুগল্প বলেছেন। কেউ কেউ আবার পনেরশো শব্দের গল্পকেও অণুগল্প ধরেছেন। চীনা সাহিত্যে অণুগল্পকে বলা হয় ‘স্মোক লং’, সিগারেট শেষ হতে হতে গল্প শেষ। অনেকেই তিন মিনিটের মধ্যে পড়ে ফেলা যাবে এমন গল্পকে অণুগল্প ধরেছেন। 

আবার হেমিংওয়ের (১৮৯৯-১৯৬১) নামে চলা ছয় শব্দের অণুগল্প ‘for sale: baby shoes, never worn.’ খুবই বিখ্যাত হলেও ততটা পরিচিত নয় জয়েস ক্যারল ওটস (Joyce Carol Oates)-এর ‘Widow’s First Year’ নামের চার শব্দের অণুগল্পটি, ‘I kept myself alive.’  আবার শুধু শিরোনাম দিয়েই একটা সাদা পাতা ছেড়ে রেখেছিলেন মেহিকোর লেখক গুইলেরমো সাম্পেরিও (Guillermo Samperio)। গল্পটির নাম ‘Fantasma’, স্পানিশ ভাষায় যার অর্থ ভূত বা বিভ্রম। 

অণুগল্পের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে কয়েকটি বিষয় প্রায় প্রত্যেক সমালোচক উল্লেখ করেছেন। স্বল্প পরিসরে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো তীব্র চেতনা প্রবাহিত হবে গল্প জুড়ে। কিন্তু বিদ্যুৎ ঝলকের অনুভূতি ঝলক শেষ হয়ে গেলেও যেমন লেগে থাকে চোখে নিটোল অণুগল্পও আমাদের অন্তর্গত চেতনার কোথাও জ্বলজ্বলে একটা আলো জাগিয়ে রাখে। অণুগল্পর শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, চেতনা ও ঘটনা প্রবাহ সবই হবে ধারালো ছুরির মতো যা থেকে ঠিকরে পড়বে আলোর ঝলকানি আর তার স্বর ও মেজাজে (tone and mood) থাকবে আলোক তরঙ্গের মতো চোরা স্রোত যা শেষ মুহূর্তে একেবারে ঠেলে উঠে যাবে পর্বত শীর্ষের দিকে।

অনেক সময়ই অণুগল্প গঠনে ও চেতনায় ঘনবদ্ধ, রূপক আশ্রিত। ফলে এর সঙ্গে কবিতার নৈকট্য অনেক বেশি। যদিও বড় একটা গল্প এমনকি উপন্যাসের পুরোটা জুড়েই কবিতার বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, থাকেও। কিন্তু কবিতাতেও তো থাকে গল্প, সংলাপ, কথনভঙ্গির বিভিন্নতা, এমনকি নাট্য মুহূর্তও। আর উপন্যাস, গল্প, নাটকেও থাকে রূপক।

নতুন লেখকেরা অনেকেই মনে করেন অণুগল্প ছোট মানেই তা লেখা সহজ। এমন মোটেও নয়। ছোট করে লেখা গল্প হলেই অণুগল্প হবে না। তাকে হতে হবে রসোত্তীর্ণ। তাতে থাকতে হবে যে কোনও গল্পের সমস্ত বৈশিষ্ট্য। গল্প বা উপন্যাসের মতো অণুগল্পেও থাকতে হবে প্লট অর্থাৎ শুরু, মধ্য ও শেষ। বলা হয়ে থাকে যে কাহিনির মধ্যভাগ থেকে শুরু করে শেষের আগেই গল্প শেষ হবে অর্থাৎ শেষে থাকতে হবে টুইস্ট। থাকতে হবে এক বা একাধিক চরিত্র এবং বর্ণনা, সময়ের গর্ভে যা প্রবাহিত হবে ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে। শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন, সংলাপ, কাঠামো সবই হতে হবে চূড়ান্তভাবে অর্থবহ ও ওজনদার অর্থাৎ শব্দকে লেবুর মতো নিংড়ে আরও আরও রস বের করে আনা। কোনও একটা শব্দ যদি অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সেটা সঙ্গে সঙ্গে বাদ দেওয়াই মঙ্গল।

গল্পের শেষে থাকতে পারে মৃদু বা তীব্র ধাক্কা যা গল্পটিকে নিয়ে যেতে পারে একটা তূরীয় উচ্চতায়। মানে ওই শেষটুকুতে ঘেঁটে যেতে পারে এতক্ষণ ধরে যা বলা হল সব ধারণা, সব অনুভূতি; অথবা এতক্ষণ ধরে বলা ঘটনা বা অনুভূতি হঠাৎ করে একটা চূড়ায় পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু এমনও নয় যে শেষের ধাক্কা স্পষ্টভাবে থাকবেই। অনেক বিখ্যাত লেখকের লেখা অণুগল্পে শেষটা এত সূক্ষ্ণ, এত সূচীমুখ যে ধাক্কা পাঠকের কাছে না-ও পৌঁছতে পারে। কাফকার অনেক অণুগল্প এমনই, অনুভূতি-বিদ্ধ। বনফুল বা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ‘নিমগাছ’ গল্পটা পড়ে দেখতে পারেন। সাদাত হোসেন মান্টোর অণুগল্পও ঘেঁটে দেখুন পাঠক।

লেখক-লেখা-পাঠক সম্পর্কটা বেশ জটিল। পাঠক রসজ্ঞ না হলে শুধু অণুগল্প কেন যে কোনও লেখাই মাঠে মারা যেতে পারে। সাহিত্যের রস গ্রহণ করার এক ধরণের অনুশীলন দরকার, পাঠের অনুশীলন, বিভিন্ন লেখকের লেখার অনন্য বৈশিষ্ট্যর সঙ্গে পরিচিতির অনুশীলন। ‘সমালোচনা সাহিত্য’-র সঙ্গে সামান্য যোগ থাকলেও মন্দ নয়। এগুলো একেবারেই ভিন্ন প্রসঙ্গ হলেও অণুগল্প ও তার পাঠক নিয়ে আলোচনায় এইসব প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য। সত্যিকারের ভাল গল্পে যা বলা হয় তার থেকেও অনেক বেশি নিহিত অর্থ থাকে তার গভীরে। অণুগল্পের ক্ষেত্রে এটা ভীষণ সত্যি। পাঠক তাঁর ব্যক্তিগত জ্ঞান, জীবন অভিজ্ঞতা ও কল্পনা মিশিয়ে গল্পটাকে নিজের মতো করে গড়ে নেবেন। শুধু অণুগল্প নয়, যে কোনও ক্রিয়েটিভ লেখার ক্ষেত্রেই পাঠক বিষয়ে একথা বলা যায়।

আবার মনে করিয়ে দিই, এসব একটাও আমার কথা নয়, বলাই বাহুল্য।

কী করে লিখতে হবে অণুগল্প?

অণুগল্প লেখক মাইকেল মারটোন (Michael Martone) বলছেন, ‘This form, ‘flash’, wants to play. It can’t be categorized. It can’t be taught. It knows not to know.’ 

অণুগল্পের প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা বা পড়া তথ্য দেখা-শোনা-পড়া এবং ভুলে যাওয়ার চক্রে চলতে থাকে। ফলে কোনও চিন্তাই করবেন না। নীচের টিপসগুলো আপনার কাজে লাগতে পারে। অণুগল্প লেখার আগে একবার শুধু পড়ে নিন আর মোবাইলে টাইপ করে বা আপনার হাতে সময় কম থাকলে ভয়েস মেসেজে লিখে ফেলুন অণুগল্প।

অণুগল্প লেখার জন্য কয়েকটা টিপস:

১। বর্ষাকাল বেছে নিন। আকাশ থেকে যখন ছুটে আসবে বিদ্যুতের ঝলক তখনই লিখে ফেলুন। ওই ঝলকের মধ্যবর্তী সময়ে যা লেখা হবে সেটাই অণুগল্প। আজকাল বর্ষাকাল ছাড়াও বজ্র বিদ্যুৎ হয়ে থাকে। ফলে বছরের যে কোনও সময় বিদ্যুৎ চমকালেই আপনার লেখার সুযোগ থাকছে। কিন্তু বিদ্যুৎ যদি না চমকায় আর আপনার বাড়িতে থাকে ওয়েস্টার্ন ওয়াশরুম, কমোডের ফ্ল্যাশ টেনে দিয়ে আপনি একইভাবে লিখে ফেলুন ফ্ল্যাশ ফিকশন।

২। মাইক্রোআভেনে কিছু শব্দ ঢুকিয়ে দিন আর তিন মিনিট বেক করুন। আপনার মাইক্রো ফিকশন তৈরি।

৩। যত রকমের রদ্দি শব্দ ও বাক্য আপনি জানেন এক জায়গায় করুন আর সেগুলোকেই ব্যবহার করুন একেকটা অণুগল্পে। বার বার ব্যবহার করুন বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ এবং ক্রিয়া বা ক্রিয়া বিশেষ্য। বাক্যের উদ্দেশ্য ও বিধেয় গুলিয়ে দিন, বাক্যটি হাত দিয়ে টেনে টেনে লম্বা করে দিন এবং ফুল-লতা-পাতা-চাঁদ-সূর্য-তারা কুড়িয়ে বাক্যের মাঝে মাঝে গুঁজে দিন। গল্পটি পরীক্ষামূলক গল্প হতে বাধ্য।

৪। বিষয় নিয়ে একদম ভাববেন না। যেমন, ‘কি সুন্দর জোছনা রাতি/ আকাশ দিয়ে উড়ে যায় পাল পাল হাতি’। শুধু অন্ত্যমিল উড়িয়ে দিন। হাতিকে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে গল্পের শেষে বেশ একটা ধাক্কাও দেওয়া যাবে। এও যদি পছন্দ না হয় খবরের কাগজ থেকে মোটামুটিভাবে পঞ্চাশ বা একশটা শব্দ কেটে নিয়ে পরপর জুড়ে দিন। দেখুন, একটা সুন্দর অণুগল্প দাঁড়িয়ে গেছে। খবরের কাগজ আজকাল সবার বাড়িতে আসে না। স্মার্ট ফোনে খুলে নিন যে কোনও লিঙ্ক। কিছু শব্দ কপি করে ডক ফাইলে বা সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ায় পেস্ট করে দিন। আপনার অণুগল্প তৈরি। লাইক, কমেন্টও পেয়ে যাবেন নিশ্চিত।

৫। লিখতে লিখতে যদি অনেক বড় হয়ে যায় লেখা, লেখার মাঝামাঝি চৌকো করে নকশা করুন, বাকিটা ফেলে দিন। যা পড়ে থাকবে সেটাই একটা নিটোল অণুগল্প হবেই হবে।

৬। একটা যে কোনও বাক্য লিখুন যা আপনি সারাদিনে বার বার ব্যবহার করে থাকেন। বাক্যটির সামনে ও পিছনের দিক থেকে বা মাঝখান থেকেও কিছু শব্দ উড়িয়ে দিন। একটা আস্ত ন্যানো ফিকশন আপনি পেয়ে যাবেন। বা মেহিকোর লেখকের মতো একটি মাত্র শব্দে শিরোনাম দিন আর বাকি পৃষ্ঠা রেখে দিন সাদা।

৭। মাইকেল মারটোন বলেই দিয়েছেন, অণুগল্প লেখার জন্য অত জানাটানার দরকার নেই এবং অণুগল্প লেখা শেখাও যায় না। ফলে আমার মতোই কিছু না পড়েই, না জেনেই অণুগল্প লিখতে শুরু করুন। 

৮। শব্দের বানান, বাক্যের গঠন, ব্যাকরণ ইত্যাদি নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। জাস্ট লিখে ফেলুন, আপনি যেভাবে যে ভাষা বলেন, জানেন সেভাবেই।

৯। একবার লিখে ফেলার পর দ্বিতীয় বার আর পড়ে দেখবেন না। ওটাই প্রকাশ করে দিন।

১০। যদি আপনি একজন মেয়ে হন তাহলে আপনার গল্পের ভেতর যেন থাকে মা-ঠাকুমা-দাদি-নানি-বাবা-জ্যাঠাদের থেকে নিরন্তর শুনতে থাকা ভাবনাগুলোই। যদি আপনি একজন ছেলে হন তাহলেও যেন একইভাবে এইসব গুণগুলোই থাকে। যার মধ্যে অবশ্যই থাকতে হবে বিয়ে, প্রেম, যৌনতা, সন্তান, লিঙ্গ, রীতিনীতি, অনুভূতি, ধর্ম, পরকীয়া ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত ধারণাগুলোই। তাহলে ‘স্লাইস অফ লাইফ’ হয়ে উঠবেই আপনার অণুগল্প।

১১। এতগুলো টিপস পেয়েও যদি অণুগল্প লেখা কঠিন মনে হয় তাহলে এক কাজ করুন, ছাদের ওপর গিয়ে গুণে গুণে দশটি ডন দিন। তারপর পিছনের রাস্তায় তাকিয়ে দেখুন, যা দেখলেন সেটাই লিখুন। গল্পটি শুরু হতে পারে এভাবে, ‘রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক দেবশিশুর মতো ফুটফুটে বালিকা……’। গল্পটা লেখার সময় আপনি মোটেও খ্যাদা নাক কালো বাচ্চাদের দিকে তাকাবেন না প্লিজ।

Author

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore