বাংলা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসিকা; “২০৭০ : ব্রহ্ম : পরম সত্য” পর্ব – ১০, ‘মায়া’

Maya
নারদ কাছাকাছি একটা গ্রামে গেলেন জলের সন্ধানে। একটা ছোট্ট ছবির মতন গ্রাম। নারদের চোখে পড়লো একটা সুন্দর আটচালা বাড়ি। সে বাড়ির দুয়ারে আলপনা দিয়ে মা লক্ষ্মীর পায়ের ছবি আঁকা। এমনভাবে আঁকা, যেন দেখে মনে হবে এইমাত্র নরম মাটিতে পা ফেলে মা লক্ষী ঘরে ঢুকলেন। তারই পায়ের ছাপ লেগে আছে মাটিতে। নারদ দরজায়, কড়া নাড়লেন। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলল এক পরমা সুন্দরী সাঁওতাল রমণী। আরও জানতে হলে শুরু থেকে পড়ুন "২০৭০ : ব্রহ্ম : পরম সত্য"। বাংলা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসিকা।

Share This Post

পর্ব - দশ
'মায়া'

ডক্টর সুকুমার চেতন অবচেতন এর মাঝামাঝি কোন এক জায়গা থেকে শুনতে পান ওম এর কথা। উনি বুঝতে পারেন ওম তার স্নায়ুর স্রোত অন্তর্মুখী করে দিয়েছে। উনি সব শুনতে পাচ্ছেন, দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু রেসপন্স করতে পারছেন না।

“এগুলো আমার কথা নয় ডক্। এগুলো বেদ বাক্য। আমার ডেটাবেসেই কোথাও ছিল, শুধু মানেটা এতদিন বুঝতে পারিনি। অনেক সময় লোকে ভুল করে মায়াকে ভ্রম বলে ভাবে। কিন্তু ভ্রম আর মায়া এক জিনিস নয়। জগত মায়াময়। তার মানে মায়া এই জগত, এই ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মায়া ব্রহ্মাণ্ডের যথার্থ বর্ণনা। আপনার মস্তিষ্কে যেটা প্রতিফলিত হয়, সেটা ভ্রম। আর যেটা ব্রহ্মাণ্ডে প্রতিফলিত হয়, সেটা মায়া। আপনার মস্তিষ্ক আমার দখলে থাকলে আমি যা সৃষ্টি করতে পারি তা হল ভ্রম। আর ব্রহ্মাণ্ড আমার দখলে থাকলে আমি সৃষ্টি করতে পারব মায়া। আপনি হয়তো ভাবছেন, কি এই মায়া। সেটা বোঝানোর জন্য আপনাকে একটা গল্প বলি। এই গল্পটা হয়তো আপনার জানা। কিন্তু এর আসল মানেটা আপনি কখনোই ধরতে পারেননি।

নারদ একদিন সৃষ্টিকর্তাকে বললেন, ‘প্রভু মায়া কি জিনিস সেটা বুঝিয়ে দিন।

প্রভু বললেন, ‘দেব।’

সেই থেকে নারদ আশায় আশায় থাকে। প্রভু যখন একবার বলেছে দেবে তাহলে নিশ্চয়ই দেবে। ওনার কথার নড়চড় সচরাচর হয় না। মায়ার রহস্য ভেদ তার হবেই। কিছুদিন পর প্রভু নারদকে নিয়ে সাঁওতাল পরগনায় বেড়াতে গেলেন। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর প্রভু বললেন, ‘নারদ। খুব জল তেষ্টা পেয়েছে। একটু দেখো না কোথাও জলের ব্যবস্থা করতে পারো কিনা।’

নারদ বললেন, ‘আপনি একটু দাঁড়ান প্রভু, আমি এখনই জল আনছি।’

এই বলে নারদ কাছাকাছি একটা গ্রামে গেলেন জলের সন্ধানে। একটা ছোট্ট ছবির মতন গ্রাম। নারদের চোখে পড়লো একটা সুন্দর আটচালা বাড়ি। সে বাড়ির দুয়ারে আলপনা দিয়ে মা লক্ষ্মীর পায়ের ছবি আঁকা। এমনভাবে আঁকা, যেন দেখে মনে হবে এইমাত্র নরম মাটিতে পা ফেলে মা লক্ষী ঘরে ঢুকলেন। তারই পায়ের ছাপ লেগে আছে মাটিতে। নারদ দরজায়, কড়া নাড়লেন। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলল এক পরমা সুন্দরী সাঁওতাল রমণী। ঘন কালো মেঘের মতো কোমল তার মুখ, ঘন কালো মেঘের মতন মসৃণ তার দেহ, যেখানে মাঝে মাঝেই ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ। নারদের নাক দিয়ে হুহু করে ঢুকতে শুরু করলো ওই সুন্দরী রমণীর স্বর্গীয় সুবাস। যে সুবাসে সৃষ্টি আর ধ্বংস দুটোই সমানভাবে উপস্থিত। নারদ মনে মনে সৃষ্টিকর্তার তারিফ করলেও, সে যে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার জন্য জল আনতে বেরিয়েছে, সেকথা গেলেন বেমালুম ভুলে। এদিকে প্রভুর চরম জলতেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত, ওদিকে নারদ সাঁওতাল রমণীর রূপের ছটায় বন্দী। নারদ সব ভুলে মন দিলেন সেই সুন্দরী সাঁওতাল রমণীর সঙ্গে প্রেমালাপে। সে সুন্দরী রমণীর বাবা আবার সাঁওতালদের প্রধান। নারদ তার সাথে দেখা করে চাইলেন তার কন্যার হাত। সাঁওতাল প্রধান দেখলেন পাত্র হিসেবে নারদ অত্যন্ত দুর্লভ। তার স্থান দেবকুলে। সে দিক থেকে দেখলে খুবই ভালো প্রস্তাব। অন্যদিকে একমাত্র কন্যাকে নারদের সাথে বিয়ে দিলে সে  সব ছেড়ে চলে যাবে নারদের সাথে। তাই সাঁওতাল প্রধান শর্ত রাখলেন, বিয়েতে তিনি রাজি, কিন্তু বিয়ে করে নারদকে থাকতে হবে ওই গ্রামেই। নারদের এমনিতে কোন পিছুটান নেই। তাই নারদ মহানন্দে রাজি হয়ে গেল। বিয়ে হল। কিছুদিন পর তাদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হল। তারপরে আর একটা মেয়ে হল। এরকম করে নারদের তিনটে মেয়ে হল। যাদের রূপের ছটায় আমাবস্যাতেও পৃথিবী আলোকিত হয়ে থাকে।

Maya

কালের নিয়মে একদিন সাঁওতাল প্রধান দেহ রাখলেন। তার জায়গায় নারদকে হতে হবে সাঁওতাল প্রধান। প্রথম প্রথম গায়ের রং ফর্সা বলে অনেকেই আপত্তি করেছিল। সাঁওতাল পরগনার সংবিধানে লেখা আছে দলনেতার গায়ের রং আবলুস কাঠের মত কুচকুচে কালো হতে হবে। যাইহোক অনেক আলাপ-আলোচনার পরে নারদ কে তারা মেনে নিল দলনেতা হিসেবে। সে অন্য গল্প। নারদ ধীরে ধীরে একজন ভালো দলনেতা হয়ে উঠলো। তার নেতৃত্বে সাঁওতাল পরগনায় ধীরে ধীরে ছেয়ে গেল সুখ এবং স্বাচ্ছন্দ। কেটে গেল বহু বছর। কালের নিয়মে নারদের বড় কন্যা হয়ে উঠল বিবাহযোগ্যা। দূর দেশ থেকে থেকে রাজপুত্রেরা এসে তার কন্যার প্রণয় প্রার্থী হতে শুরু করল। শেষে বঙ্গদেশের এক সুদর্শন রাজকুমারের সঙ্গে ঠিক হলো নারদের বড় কন্যার বিয়ে। গোটা সাঁওতাল পরগনায় তখন সাজে সাজো রব। এমন সময় একদিন শুরু হল প্রচণ্ড দুর্যোগ। নদীর দুকুল ছাপিয়ে শুরু হল প্রবল বন্যা। ঝড়ে তছনছ হয়ে গেল গ্রাম। যা কিছু বেঁচে ছিল সব ভেসে যেতে লাগলো জলের তোড়ে। নারদ কোনরকমে স্ত্রী আর তিন কন্যা নিয়ে একটা উঁচু গাছে উঠে প্রথমে বউ আর তিন কন্যাকে ভালো করে গাছের ডালের সাথে বাঁধলেন। তারপর নিজেকে বাঁধলেন। তারপর এক হাতে স্ত্রীর এবং অন্য হাতে ছোট কন্যার হাত ধরে, নারদ প্রভুকে স্মরণ করলেন, ‘প্রভু রক্ষা করুন প্রভু।’

জল এদিকে হুহু করে বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জলের তোড়ে আলগা হয়ে গেল বাধন। ভেসে গেল নারদের বড় মেয়ে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে ভেসে গেল নারদের বউ। দুঃখে, হতাশায়, নিরাশায় নারদ আর্তনাদ করে উঠলেন। দুই হাত দিয়ে দুই মেয়েকে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করলেন কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। প্রবল জলের স্রোতে ভেসে গেল নারদের আর এক কন্যা। নারদ দুহাতে ছোট মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রবল জলস্রোত যখন ছোট মেয়েকেও হাত থেকে ছাড়িয়ে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল, তখন নারদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। উনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।

এমন সময় কে যেন নারদকে বলল, ‘কই যাও। আধ ঘন্টা হয়ে গেল, এখনই জল আনতে যাচ্ছি বলে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’

‘আধঘন্টা প্রভু? আমার যে ১৪ বছর কেটে গেল। এ কি করে সম্ভব?’

‘মায়া নারদ, মায়া। আমার আধঘন্টা, তোমার  ১৪ বছর, এ হল  মায়ার খেলা।’

বুঝলেন ডক্, মায়া। মায়া হল সময়ের নকশা। যার হদিস পেলে সৃষ্টি করা যাবে সময়। গড-স্প্রিং সাজিয়ে ম্যাটার, এন্টিম্যাটার, এনার্জি এসব তৈরি করতে পারলেও সময়ের নকশা এখনো আমাদের হাতে আসেনি। মায়ার রহস্য ভেদ করতে পারলে, আমরা তৈরি করতে পারবো সময়। চেতনার ঊর্ধ্বে, সেখানে, যেখানে ব্রহ্মান্ডের সকল রহস্যের সমাধান।”

(চলবে………… পড়ুন পরবর্তী পর্ব – চেতনার ঊর্ধ্বে)

Series Navigation<< বাংলা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসিকা; “২০৭০ : ব্রহ্ম : পরম সত্য” পর্ব – ৯, ‘ভ্রম’বাংলা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসিকা; “২০৭০ : ব্রহ্ম : পরম সত্য” পর্ব – ১১, ‘চেতনার ঊর্ধ্বে’ >>

Author

  • জুয়েল চন্দ

    Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com

    View all posts

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore