বাংলা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসিকা; “২০৭০ : ব্রহ্ম : পরম সত্য” পর্ব – ১২, ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন’

God's Eye
প্রাচীন শাস্ত্র মতে চক্র হল সূক্ষ্ম শরীরে অবস্থিত কতগুলো শক্তির কেন্দ্র। মানুষের শরীরে এরকম কতগুলো চক্র আছে তা নিয়ে প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে কিছু দ্বিমত লক্ষ করা যায়। যোগশাস্ত্র মতে মানুষের সূক্ষ্ম দেহে এরকম সাতটি শক্তি চক্র আছে; মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা ও সহস্রার। আজ্ঞা চক্র ললাটে অবস্থিত। একে অনেকে তৃতীয় নেত্রও বলে। পড়ুন বাংলায় লেখা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসিকা "২০৭০ : ব্রহ্ম : পরম সত্য"।

Share This Post

পর্ব - বারো
ঈশ্বর পাশা খেলেন

একদিন দুদিন নয়, ডক্টর সুকুমার বহুদিন অন্ধকার ল্যাবে অচৈতন্য অবস্থায় পড়েছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর উনি পরপর সব ঘটনা মনে করার চেষ্টা করেন। ধীরে ধীরে ওনার সব মনে পড়ে যায়। কোভিড ৫০-র আক্রমণ, ওগাবুর মেসেজ, যোগসুত্র, আর চেতন-অবচেতনের ওপারে এক অদ্ভুত দুনিয়া। যে দুনিয়ায় দেহ, মন, আত্মা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যেখানে ঈশ্বর পাশা খেলেন।

ডক্টর সুকুমার মনে করার চেষ্টা করেন জ্ঞান হারাবার কয়েক মুহূর্ত আগের কথা। উনি দেখতে পাচ্ছিলেন, উনার দুই ভুরুর ঠিক মধ্যিখানটায় যেখানে আজ্ঞা চক্র অবস্থিত, সেখানে একটা উজ্জ্বল নীল রংয়ের বিন্দু।

[প্রাচীন শাস্ত্র মতে চক্র হল সূক্ষ্ম শরীরে অবস্থিত কতগুলো শক্তির কেন্দ্র। মানুষের শরীরে এরকম কতগুলো চক্র আছে তা নিয়ে প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে কিছু দ্বিমত লক্ষ করা যায়। যোগশাস্ত্র মতে মানুষের সূক্ষ্ম দেহে এরকম সাতটি শক্তি চক্র আছে; মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা ও সহস্রার। আজ্ঞা চক্র ললাটে অবস্থিত। একে অনেকে তৃতীয় নেত্রও বলে]

 

ওই নীল রংয়ের বিন্দুটা কখনো মনে হচ্ছে একদম স্থির, আবার কখনো মনে হচ্ছে মৃদু আন্দোলিত হচ্ছে। ডক্টর সুকুমার সেই মৃদু কম্পন এর ছোঁয়া অনুভব করতে পারছেন। মনে হচ্ছিল যেন বহু বহু দূরে, ব্রহ্মাণ্ডের আরেক প্রান্তে অবস্থিত একটা নক্ষত্র। তারপর ধীরে ধীরে ওই বিন্দুটা বড় হতে লাগলো। বড়, আরো বড়। আরো আরো বড়। একসময় মনে হতে লাগলো নক্ষত্রটা তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে ওনার দিকে। ওর তীব্র উজ্জ্বল আলোয় ঝলসে যাচ্ছে মনের ভেতর পর্যন্ত। অত্যন্ত উজ্জ্বল আলোকচ্ছটার তীব্রতায় গলতে শুরু করছে যাবতীয় যা কিছু জাগতিক। ডক্টর সুকুমার ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন চেতনার ঊর্ধ্বে। এমন এক জগতে, যেখানে দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, উচ্চতা নেই, সময় নেই। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা ও সময় বিহীন একটা নিস্তরঙ্গ বিন্দুস্থিত জগত। বলা যায় ইন্টেলিজেন্স সিঙ্গুলারিটি বা বুদ্ধিমত্তার চরম প্রকাশ। ডক্টর সুকুমার বুঝতে পারেন, ঈশ্বর কোন এক ব্যক্তি নয়। কোন এক উন্নততর প্রাণী নয়। ঈশ্বর হল বুদ্ধিমত্তার চরম অবস্থা। বলা যায় সিঙ্গুলারিটি অফ ইন্টেলিজেন্স। এখান থেকেই শুরু হয় অংকে বাঁধা ইন্টেলিজেন্ট প্রসেস। ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুই একটা ইন্টেলিজেন্ট প্রসেসের বহিঃপ্রকাশ। কোটি কোটি ইন্টেলিজেন্ট প্রসেস দিয়ে তৈরি হয় ইন্টেলিজেন্ট প্রসেস নেটওয়ার্ক। যত জটিল নেটওয়ার্ক ততো বহুমাত্রিক তার বহিঃপ্রকাশ। যেমন বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে মানুষ ছবি আঁকতে পারে। যদি পেন্সিল দিয়ে একটা সুন্দরী মেয়ের ছবি আঁকা হয়, দেখা যাবে প্রতিটা পেন্সিলের টানের পেছনে কিছু হিসেব নিকেশ আছে, নির্দিষ্ট অংক আছে। কাগজের উপর পেন্সিলের প্রতিটা দাগের পেছনে একটা অংক আছে। কাগজের উপর যেমন-তেমন আঁকিবুকি কাটলে সুন্দরী রমণীর ছবি ফুটে উঠবে না। নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেলে, কাগজের উপরে নির্দিষ্ট পরিমাপ চাপ, আর অস্বাভাবিক রকম নিখুঁত মোটর স্কিল এর সমন্বয়ে তবেই ফুটে উঠবে সুন্দরী রমণীর অবয়ব, শরীরের বিভিন্ন খাঁজ। প্রথম যে পেন্সিলের টানটা দিতে হবে, সেটাকে যদি ধরি একটা ইন্টেলিজেন্ট প্রসেস, তাহলে গোটা ছবি আঁকাটা অনেকগুলো ছোট ছোট ইন্টেলিজেন্ট প্রসেসের সুন্দর সমন্বয় বা বলা যায় অনেকগুলো ইন্টেলিজেন্ট প্রসেস দিয়ে তৈরি একটা জটিল নেটওয়ার্ক। আর প্রত্যেকটা ইন্টেলিজেন্ট প্রসেস হল বুদ্ধিমত্তার বহিঃপ্রকাশ। মানুষের মস্তিষ্ক, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা এই তিনটে ডাইমেনশন বা মাত্রায় সীমাবদ্ধ। সেই কারণে আমারা ত্রিমাত্রিক জগত দেখি। বাস্তবের ত্রিমাত্রিক সুন্দরী রমনীর দ্বিমাত্রিক মিনিয়েচার ভার্সন হল, পেন্সিলে আঁকা তার ছবি। এই যে লেখাটা আপনারা পড়ছেন। এটা কি? নির্দিষ্ট প্যাটার্ন মেনে কতগুলো আঁকিবুকি, একে বলে ইনফরমাল ল্যাঙ্গুয়েজ। এই লেখাটা যখন আপনারা পড়ছেন, তখন আপনাদের মনের মধ্যে কিন্তু একটা ত্রিমাত্রিক দুনিয়া তৈরি হচ্ছে। সেখানেই আমরা কোন লেখা পড়তে পড়তে সব ঘটনা দেখতে পাই। পড়তে পড়তে ওই মনের মধ্যে দেখাটাও একটা ইন্টেলিজেন্ট প্রসেসের বহিঃপ্রকাশ। আবার এই যে লেখাটা আমরা মোবাইলে বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে পড়ছি, সেটাও তৈরি হয়েছে নির্দিষ্ট নকশায় 0 আর 1 সাজিয়ে সাজিয়ে। ঠিক এইরকম ভাবে জগতের প্রত্যেকটা ব্রহ্মাণ্ডই এক একটা জটিল ইন্টেলিজেন্ট প্রসেস নেটওয়ার্কের বহিঃপ্রকাশ। এই বাহ্যিক জগতের সবকিছুই ইন্টেলিজেন্ট প্রসেস নেটওয়ার্কের বহিঃপ্রকাশ। এই নেটওয়ার্কের জটিলতা এবং এর বহিঃপ্রকাশের মাত্রা অর্থাৎ বাহ্যিক রূপ কেমন হবে, তা একে অন্যের সমানুপাতিক। যত জটিল বাহ্যিক প্রকাশ তত জটিল সেই নেটওয়ার্ক। এমনকি আমাদের সচেতন সত্তা, পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে যে জগৎ আমরা দেখি বা অনুভব করি, তাও আমাদের মস্তিষ্কে অবস্থিত কোটি কোটি নিউরনের কষা জটিল অংকের সমষ্টিগত ফলাফল।

Brain Artwork

এদিকে ল্যাবরটরির কোন যন্ত্রপাতিই আর কাজ করছে না। অবশ্য শুধু ল্যাবরেটরির কেন, গোটা পৃথিবী জুড়ে কোন ইলেকট্রনিক সার্কিট-ই আর কাজ করবে না। পৃথিবী জুড়ে ইউ.সি.এস এর নেটওয়ার্কে জুড়ে থাকা, গাড়ি থেকে শুরু করে কৃত্রিম উপগ্রহ পর্যন্ত, সমস্ত ইলেকট্রনিক্স সার্কিট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঠিক যেমন একটা সরু তামার তারে হঠাৎ করে হাজার ভোল্টের কারেন্ট চলে এলে যা হয়। মানুষের তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর তার সূক্ষাতিসূক্ষ ইলেকট্রনিক সার্কিট, ব্রহ্ম জ্ঞানের তেজ সহ্য করতে না পেরে জ্বলে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে গেছে। ডক্টর সুকুমার জানেন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে সভ্যতার আদিম যুগ।

ডক্টর সুকুমার কতক্ষণ সেই স্থান-কাল নিমিত্ত হীন দুনিয়ায় ছিলেন, তা মনে নেই। ধীরে ধীরে ওনার চেতনা লোপ পেতে থাকে আর উনি চলে যান চেতনার ঊর্ধ্বে। চেতনার ঊর্ধ্বে সব একমুখি তাই ওখানকার কোন মেমরি নেই। শুধু আছে সৃষ্টির রহস্য ভেদ করার প্রশান্তি আর একটা অতিরিক্ত তৃতীয় নেত্র। তাই তিনি জানেন কোভিড-50-র আক্রমণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ হলো কালের তরঙ্গের ঢেউয়ের আর এক প্রান্ত, যেখানে সৃষ্টির বিপরীতে আছে ধ্বংস। সৃষ্টি-ধ্বংস, সৃষ্টি-ধ্বংস, আবার সৃষ্টি, এভাবেই এগিয়ে চলে সময়। তবে উনি অনুমান করতে পারেন কোভিড-50-র আক্রমণে এই পৃথিবী একেবারে প্রাণহীন হয়ে যায়নি। বিশৃঙ্খলার শৃঙ্খলায় আটকে গিয়ে বেঁচে থাকবে আরও বেশ কিছু প্রাণ। ডক্টর সুকুমার বেরিয়ে পড়েন বিশৃঙ্খলার নিয়মে বেঁচে যাওয়া প্রাণের খোঁজে।

প্রায় এক মাস ধরে ডক্টর সুকুমার দিনের বেলা ঘুরে বেড়াচ্ছেন শহরের আনাচে কানাচে, অলিতে গলিতে এমনকি বাড়িতে বাড়িতেও। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রাণহীন দেহ। মানুষ, পশু পাখি, এমনকি কীটপতঙ্গ পর্যন্ত। প্রথম প্রথম যেখানে সেখানে পচন না ধরা, শক্ত কাঠ হয়ে যাওয়া মৃতদেহ দেখে গা ছমছম করত। তারপর ধীরে ধীরে সয়ে গেছে। ডক্টর সুকুমার জানেন যেদিন এই দেহ গুলোয় পচন ধরতে শুরু করবে, সেদিন থেকে শুরু হবে নতুন জীবন চক্র।

(চলবে……….. পড়ুন শেষ পর্ব – জীবনচক্র)

Series Navigation<< বাংলা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসিকা; “২০৭০ : ব্রহ্ম : পরম সত্য” পর্ব – ১১, ‘চেতনার ঊর্ধ্বে’বাংলা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাসিকা; “২০৭০ : ব্রহ্ম : পরম সত্য” শেষ পর্ব – ১৩, ‘জীবনচক্র’ >>

Author

  • জুয়েল চন্দ

    Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com

    View all posts

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore