পর্ব – তিন
সংকেত
ডঃ সুকুমারের মন ভালো নেই। এই মুহূর্তে ওর নিজেকে বড় একা মনে হচ্ছে। অবশ্য এমন পরিস্থিতি কারই বা ভালো লাগবে। পুরো ব্যাপারটা সুকুমারের কাছে একটা দুঃস্বপ্নের মতন। কোভিড-৫০ একটা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ভাইরাস। ভাইরাস বলতে আমরা যা জানি এটা ঠিক তা নয়। আমরা জানি ভাইরাস এক ধরনের অতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক জীব। সঠিকভাবে বলতে গেলে জীব নয়। ভাইরাসকে বরং বস্তু বলা ঠিক হবে। কারন যতক্ষণ না ভাইরাস কোন পোষক বা হোস্ট- এর দেহে প্রবেশ করছে, ততক্ষণ সে নির্জীব। কিন্তু একবার হোস্ট- এর দেহে প্রবেশ করতে পারলেই এরা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বংশ বিস্তার শুরু করে।
‘ওম’-এর বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয় (‘ওম’ হল ইউ.সি.এস এর আনুষ্ঠানিক নাম। বলাবাহুল্য যে নামটা তাকে সুকুমারই দিয়েছে।) তাহলে কোভিড-৫০ র সৃষ্টি এই পৃথিবীর বাইরে। এই কোভিড-৫০ -কে কিন্তু বস্তু বলা যাবে না। এরা স্বয়ংসম্পূর্ণ, বায়ুবাহিত এবং হোস্ট ছাড়াই বংশ বিস্তার করতে সক্ষম। অনেককাল আগে যেমন পরিবেশ দূষণের ফলে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে চলেছিল, পরিস্থিতি অনেকটা ঠিক সেই রকম। বাতাসে ভাসমান কোভিড-৫০ -র সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এর গঠন অনেকটা কোভিড গোত্রীয় ভাইরাসের মতো হলেও, এরা প্রতিবস্তু অর্থাৎ অ্যান্টি-ম্যাটার দিয়ে তৈরি। যেন ভাইরাস নয়, ভাইরাসের ভূত। এরা মানুষের দেহে বাসা বাঁধে না। শুধু দেহ ভেদ করে চলে যায়। যেন লক্ষ লক্ষ ভাইরাস একের পর এক মানুষের দেহ ভেদ করে চলে যাচ্ছে আর যাবার সময় শুষে নিয়ে যাচ্ছে তার প্রাণ। কয়েক মুহূর্তে শহরের পর শহর প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে। শুধু মানুষ নয় জীবজন্তু পশুপাখি কিছুই বাদ যাচ্ছে না। এমনকি মৃত্যুর পরে দেহে পচন পর্যন্ত ধরছেনা, কারণ পচন ধরার জন্য প্রয়োজনীয় অনুজীবরাও বেঁচে নেই।
মহা সংকট। শুধু মানুষের নয়, সমগ্র প্রাণীকুলের সংকট। মহাশক্তিশালী অসীম বুদ্ধিসম্পন্ন ‘ওম’ হাত তুলে দিয়েছে। এই বিপদের সময় কোন কাজেই সে আসছে না।
ওদিকে ওগাবুর সঙ্গেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এর একটাই অর্থ। ওগাবু আর বেঁচে নেই। একমাত্র মৃত মানুষের সঙ্গেই ‘ওম’ যোগাযোগ করতে পারেনা। যতক্ষণ না কোনো মানুষের মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটছে ততক্ষণ পর্যন্ত ‘ওম’ তার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এমন কি মানুষ কোমায় থাকলেও পারে।
ওগাবুর সঙ্গে সুকুমারের আলাপ প্রায় ২৫ বছর আগে এক কনফারেন্সে। তখন দুজনেই যুবক এবং অত্যন্ত সম্ভাবনাময় উদীয়মান বৈজ্ঞানিক। প্রথমদিকে দুজনেরই একে অন্যকে পেশাদার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হতো। তারপরে যত সময় গড়িয়েছে, তত দুজনের সম্পর্ক গভীর হয়েছে। প্রথমে বন্ধুত্ব, তারপর গভীর বন্ধুত্ব। সায়েন্স কাউন্সিলের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান বরাবর এই দুই বন্ধু ভাগাভাগি করে নিয়েছে। পরিনীতার মৃত্যুর পর আর কোন মানুষের মৃত্যু বা মৃত্যুর সম্ভাবনা সুকুমারকে এত কষ্ট দিতে পারেনি। প্রিয় জন বলতে যা বোঝায় তা ওগাবু ছাড়া সুকুমারের আর কেউ ছিলনা। যে নিজের জীবন মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছে, সে যে নিজেকে সংসারের মায়া জালে আবদ্ধ করবেনা সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের হৃদয়ও মানুষের মতো সামাজিক জীব। দল পাকাতে ওস্তাদ। তাই আরেকটা হৃদয় পেলে তাকে কাছে টানার জন্য ছোঁক ছোঁক করে। সুতরাং হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা বন্ধুর মৃত্যু মেনে নেওয়া সত্তরোর্ধ্ব সুকুমার এর পক্ষে যে অত্যন্ত কঠিন হবে, সে নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। তাই এই মুহূর্তে মৃত্যুর মিছিলের মধ্যে বসে থেকেও সুকুমারের বুকের ভেতরটা ওগাবুর জন্য মুচড়ে উঠছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর মধ্যে থেকেও ওগাবুর মৃত্যুটা যেন বেশি করে প্রকট হয়ে উঠছে।
সুকুমার নিজের মনেই বলে, “হে ঈশ্বর এ তুমি কি করলে?”
‘ওম’, হঠাৎ বলে ওঠে, “ডক্টর ওগাবুর একটা মেসেজ আমি রিসিভ করেছিলাম। একটু গোলমেলে টাইপের। ওই তোমাদের মিনিংলেস জোকস গুলোর মতন। তেমন ইম্পর্টেন্স নেই বলে আমি প্রায়রিটি অনুযায়ী ওটাকে ওয়েটিং ফোল্ডারে রেখেছিলাম। তবে ওই মেসেজটা তেও ঈশ্বরের কথা বলা আছে। কিন্তু ডক্, আপনি তো চরম নাস্তিক। আপনিও সাধারন মানুষের মতন বিপদে পড়ে কোন এক কাল্পনিক ঈশ্বরের শরণাপন্ন হচ্ছেন?”
[আমরা যদিও জানি যে ডক্টর সুকুমার আর ‘ওম’, মানে ইউ.সি.এস, শব্দের মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান করে না। ওদের ভাবের আদান-প্রদানটা মস্তিষ্কের ভিতরে হয়। মানে গোদা বাংলায় ওরা মনে মনে কথা বলে। তবুও সাহিত্যের স্বার্থে ওদের কথোপকথনটা এখানে আমি সাধারন ভাবে উপস্থাপন করছি।]
“ওগাবুর মিনিংলেস জোকস?” সুকুমারের ভুরু দুটো একদম কাছাকাছি চলে আসে।
“কই দেখি?”
মেসেজটা একবার পড়েই চিৎকার করে ওঠে সুকুমার, “নির্বোধ। তুমি একটা ইমোশনলেশ নির্বোধ। হে ঈশ্বর কার হাতে দিয়েছি আমি পৃথিবীর ভার।।”
“আমার কোন দোষ নেই ডক্। আমার আবেগ নেই, কারণ তুমি আবেগ কোড করতে পারোনি। মেসেজটা পড়ে আমি কোন মানে বুঝতে পারিনি। ইনফ্যাক্ট মেসেজটার কোন লিটারাল মানে নেই। সিম্পল ননএনক্রিপটেড মেসেজ। তাই প্রটোকল অনুযায়ী আমি ওটাকে কোন প্রায়োরিটি দিইনি।”
সুকুমার বারবার পড়তে থাকে তার উদ্দেশ্যে পাঠানো ওগাবুর শেষ মেসেজ।
“বন্ধু সুকুমার। মাদার আর্থ ইজ নট ইন ডেঞ্জার। আমার আন্দাজ তুমি এখন স্লিপ মডুলেটর এর ভিতর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছ। আমার বিশ্বাস, হয়তো তোমার ঘুমও আর কোনদিন ভাঙবেনা। নতজানু হয়ে ঈশ্বরকে ডেকো, কেবলমাত্র ঈশ্বরই পারেন এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করতে। যদি তোমার ঘুম না ভাঙ্গে, যদি তুমি জেগে না ওঠো, তবে ঈশ্বর সহায় হবেন না।”
কখনো মনে হচ্ছে মেসেজটা অসম্পূর্ণ। কখনো মনে হচ্ছে এর একটা গভীর মানে আছে। ওগাবু কি বুঝতে পেরেছিল তার মৃত্যু আসন্ন। তাই কি শেষবারের মতন যোগাযোগ করতে চেয়েছিলো সুকুমারের সাথে? কি বলতে চেয়েছিল ওগাবু? সে যদি বুঝতেই পেরেছিল আসন্ন বিপদের কথা, তাহলে সে সঙ্গে সঙ্গে ওমকে বলল না কেন তাকে জাগিয়ে তুলতে? এরকম নানা প্রশ্ন সুকুমারের মাথার ভেতর জটলা পাকাচ্ছে। যার কোনটারই উত্তর সুকুমার ঠাওর করতে পারছে না।
নিখাদ মজা করার পাত্র ওগাবু নয়। কিছুতো একটা সংকেত লুকিয়ে আছে ওগাবুর এই মেসেজটার মধ্যে।
ওগাবুর এই মেসেজ আর স্লিপ মডুলেটর থেকে তাকে ঘুম থেকে তোলার মধ্যে তিন ঘন্টার সময়ের ব্যবধান। তারমানে সঙ্গে সঙ্গে এই মেসেজটা পেলে হাতে অন্তত তিন ঘন্টা পাওয়া যেত এই পৃথিবীটাকে বাঁচানোর জন্য। সুকুমারের খুব হতাশ লাগে। নিজের সৃষ্টি করা অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন ‘ওম’কে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ইচ্ছে করছে ওটাকে শাটডাউন করে দিতে। কিন্তু সেটা করলে এই বিপদের দিনে হাতে আর লড়াই করার মতন কিছু থাকবে না। সেটা অনেকটা আত্মহত্যার শামিল।
“আপনি রেগে গেছেন। আপনার ব্লাড প্রেসার সাময়িকভাবে বেড়েছে। আপনার মস্তিষ্কের আবেগ সৃষ্টিকারী স্নায়ুগুলো গুলো এই মুহূর্তে অতিমাত্রায় সক্রিয়। আপনার শরীরে হতাশার সৃষ্টিকারী হরমোনগুলো বেশি পরিমাণে নিঃসৃত হতে শুরু করেছে। এগুলো সব কটা একসঙ্গে আপনার মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করছে। আপনি লজিকালি ভাবছেন না। তাই আমাকে দোষ দিচ্ছেন। ডক্টর ওগাবু যদি সত্যিই কোভিড ৫০ সংক্রান্ত বিপদের কথা জানতেন তাহলে উনি কোন হেঁয়ালি করতেন না। উনি সরাসরি আমাকে বলতেন আপনাকে জাগিয়ে তোলার জন্য। আমি যা করেছি সেটা যথেষ্ট যুক্তিসংগত। হয়তো আমার জায়গায় থাকলে আপনিও তাই করতেন। এই সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আপনি ভুলে যাবেন না আপনি আমার সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং আমি ফেল করলে আপনাকেই আমাকে গাইড করতে হবে। এখন আমায় অনুমতি দিন আপনার স্নায়ুতন্ত্রের ব্যালেন্সটা ফিরিয়ে আনি। ডিপ্রেশনের হরমোনগুলোর নিঃসরণটা বন্ধ করি। তাতে আপনার চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতাটা স্বাভাবিক হবে।”
কথাগুলো অবশ্য ‘ওম’ ঠিকই বলেছে। যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করে বলে সুকুমার নিজেই চায়নি ‘ওম’ -এর আবেগ থাক। তবুও ওর মন বলছে কিছুতো একটা আছে ওগাবুর মেসেজটায়। আর সেটা বোঝার জন্য নিজের মাথা থেকে আবেগগুলোকে তাড়াতে হবে।
“অনুমতি দিলাম আমার স্নায়ুতন্ত্রের আর আমার দেহের হরমোনাল ব্যালান্স স্বাভাবিক করার।”
ইতিমধ্যে আরো তিন দিন কেটে গেছে। ওগাবুর মেসেজের কোন মানে বার করা যায়নি। ডক্টর সুকুমার নাওয়া খাওয়া ভুলে মেসেজটা বারবার পড়ছেন। উনি বেশ বুঝতে পারছেন ওনার বুদ্ধি আর আগের মতন সাড়া দিচ্ছে না। বয়সের সাথে সাথে বুদ্ধির ধারও বোধহয় কমে এসেছে। ওদিকে ‘ওম’-ও বসে নেই। ওটার মধ্যে কোন সংকেত লুকিয়ে আছে কিনা জানার জন্য, আর থাকলে সে সংকেতের মানে উদ্ধার করার জন্য, সংকেত বিদ্যার সব ধরনের তত্ত্ব ক্রমাগত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ওটার ওপর প্রয়োগ করে চলেছে। কিন্তু আপাতত দুজনেই ব্যর্থ।
“ডক্, আপনার ঠিক কেন মনে হচ্ছে বলুন তো এই মেসেজটা একটা সংকেত?”
“সেটা বোঝার ক্ষমতা যদি তোমার থাকতো তাহলেতো তুমি মানেটা বুঝতে। তোমার যে এটা বোঝার ক্ষমতাই নেই।”
সুকুমার আনমনেই উত্তর দেয়। উত্তরটা দিয়েই এক মুহূর্তের জন্য সুকুমারের মাথার ভিতরে সমস্ত নিউরনগুলোয় যেন একটা বিদ্যুতের ঝিলিক জ্বলে উঠেই নিভে গেল। সুকুমারের চোখের সামনে সবকিছু জলের মতন পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ওগাবু জানতো এই মেসেজের মানে ‘ওম’ ধরতে পারবে না। তাই ইচ্ছে করেই ওগাবু এই মেসেজের মধ্যে দিয়ে সুকুমারকে বলে দিয়ে গেছে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাবার উপায়। ওগাবুকে সংকেতের সাহায্য নিতে হয়েছে কারণ ‘ওম’-কে এড়িয়ে সুকুমার এর কাছে মেসেজ পাঠাবার আর অন্য কোনো উপায় ছিল না।
(চলবে……………… পড়ুন পরবর্তী পর্ব – হেঁয়ালি)