পর্ব - পাঁচ
ঈশ্বর
“ওগাবুর ম্যাসেজটায় কোন হেঁয়ালিই নেই। অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ওগাবু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত আমাদের সৃষ্টিকর্তা আড়াল থেকে আমাদের ওপর নজর রাখছে। যেদিন মানুষ নিজেকে আর রক্ষা করতে পারবেনা, মানুষের অস্তিত্বের সংকট হবে, সেদিন একমাত্র ঈশ্বরই সহায় হবেন।”
এই ঈশ্বরের ব্যাপারটা ‘ওম’ এর বরাবর গোলমেলে লাগে।এই ব্রহ্মান্ডের যে কটা রহস্যের সমাধান সে এখনো করতে পারেনি তার মধ্যে এটা একটা।
“এর মধ্যে গোলমাল এর কিছু নেই। অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। এই যে মানুষের জিনের মধ্যে ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) কোডে সুনির্দিষ্টভাবে লেখা থাকে কিভাবেএকটা ডিম্বানু আর একটা শুক্রাণুর মিলনের মুহূর্ত থেকে ধীরে ধীরে একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষের সৃষ্টি হবে। ঠিক কতদিন ধরে চলবে এই সৃষ্টির খেলা। কিভাবে সে শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং বার্ধক্য পেরিয়ে আবার পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। তোমার কি মনে হয় প্রাণের এই জটিল নকশা নিজে নিজেই হয়ে গেছে? কাউকে সে নকশা আঁকতে হয়নি? একটা এককোষী প্রাণী থেকে নিজে নিজে এমনি এমনিই একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষের সৃষ্টি হয়ে যায়?বিবর্তন কি কেবলই সমাপতন? এর পিছনে কোন সুনিশ্চিত পরিকল্পনা নেই? তুমি একটা চাকা ডিজাইন করলে আর রেখে দিলে। তারপর নিজে নিজেই সেই ডিজাইন থেকে তৈরি হল চাকা।চাকার বিবর্তনে হল সাইকেল। কিছুদিন পর সাইকেল হয়েগেল গাড়ি। তারপর একদিন গাড়ি উড়ে গেল উড়োজাহাজ হয়ে। সুচিন্তিত সুপরিকল্পনা ছাড়া তা কি সম্ভব?”
“আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু বেশ কয়েকটা ব্রহ্মাণ্ড চষে ফেলেও আমরা কোন ঐশ্বরিক সত্ত্বার কোন প্রমাণ এখনো পাইনি। সত্যিই যদি তেমন কোন সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ উন্নততর বুদ্ধিমান সত্তা থাকতো তাহলে তার অস্তিত্বের কোনো না কোন সূত্র তো নিশ্চয়ই থাকতো।”
“সূত্র আছে। আমার বিশ্বাস ওগাবু সেই সূত্রের সমাধান করতে পেরেছিল। সৃষ্টি আর সৃষ্টিকর্তার যোগসূত্র। ওগাবুর সাথে আমার শেষ কবে কথা হয়েছিল?”
‘ওম’ পাস্ট ডেটাবেস থেকে ডক্টর সুকুমার আর ডক্টর ওগাবুর শেষ কথোপকথন খুঁজে বার করে পুনর্নির্মাণ করে। যা বাংলায় অনুবাদ করলে অনেকটা ঠিক এইরকম দাঁড়ায়;
“কি ভাই ওগাবু, খবর কি?”
“বিশেষ কোন খবর নেই ভাই। বয়স হয়ে যাচ্ছে।”
“সেকি তুমি না বলো, এজ ইজ নাথিং বাট এ নাম্বার। এ তো দেখছি উল্টো গান গাইছ। আর তোমার যোগসূত্র কেমন চলছে। নাকি মোক্ষলাভ করে বন্ধুর কাছে চেপে যাচ্ছ।”
“বলব ভায়া বলবো। কিন্তু এসব কথা মনে মনে নয়, শুনতে হবে সামনা সামনি। দেখা হোক তারপর বলব, কেমন যোগ দিয়ে যোগসূত্রের সমাধান করেছি।
“তাহলে মোক্ষলাভ আর বেশি দূরে নেই কি বলো? খুব শিগগিরই বিভূতি দর্শনে যেতে হবে মনে হচ্ছে।”
এরপর দুই বন্ধুই হো হো করে হেসে ওঠে এবং তাদের কথোপকথন অন্যদিকে মোড় নেয়।
“বেশ কয়েক বছর ধরেই ওগাবু প্রাচীন ধর্ম নিয়ে গবেষণা করছিল। কিছুদিনের মধ্যেই তার গবেষণা কেন্দ্রীভূত হয় প্রাচীন ভারতীয় যোগসূত্রে। প্রথম প্রথম আমি ব্যাপারটাকে পাগলামোই ভেবেছিলাম। কিন্তু ওগাবুর মতন একজন ব্যক্তিত্ব যখন বলে, যোগ দিয়ে যোগসূত্রের সমাধান করে ফেলেছে, তখন সে কথা উপেক্ষা করা মুর্খামি ছাড়া কিছুই নয়। তাই আমাদেরও ওই যোগসূত্র খুঁজে বার করতে হবে, যার মাধ্যমে সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়।”
‘ওম’ ঝট করে একবার সুকুমারের সম্পূর্ণ স্নায়ুতন্ত্র স্ক্যান করে নেয়। অনেক সময় আকস্মিক শক এর ফলে মানুষ মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নাহ্! ডক্টর সুকুমারের মধ্যে মানসিক বিকার এর কোন চিহ্ন নেই। তবে কি সত্যি ঈশ্বর এই ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি করেছেন। ব্রহ্মাণ্ডের অনেক রহস্যের সমাধানই সে করে ফেলেছে। পদার্থবিজ্ঞানকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স, স্ট্রিং এবং সবশেষে বিন্দু-গ্রাফ থিওরির গোলকধাঁধা থেকে বার করে প্রতিষ্ঠা করেছে বহুকাঙ্খিত থিওরি অফ এভরিথিং। গড স্প্রিং থিওরি। যা কিনা আজও পদার্থবিদ্যার শেষ থিওরি। গড স্প্রিং থিওরি অনুযায়ী ব্রহ্মান্ডের সমস্ত কিছুর মূল অর্থাৎ বিল্ডিং ব্লক হল একটা তরঙ্গ। একে বলা হয় গড স্প্রিং বা ঈশ্বর তরঙ্গ। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা বিহীন বিন্দুস্থিত একটা তরঙ্গ। স্পেস, টাইম, ম্যাটার, অ্যান্টি-ম্যাটার, এনার্জি, ডার্ক-এনার্জি, সবই আসলে নির্দিষ্ট প্যাটার্নে সাজান গড-স্প্রিং দিয়ে তৈরি জালিকা। ঈশ্বর তরঙ্গের জাল বুনে ওই নির্দিষ্ট প্যাটার্ন তৈরি করতে পারলেই তৈরি করা যায় সব ধরনের ম্যাটার, অ্যান্টি ম্যাটার অথবা এনার্জি। নকশা জানা থাকলে গড-স্প্রিং সাজিয়ে সাজিয়ে তৈরি করা যাবে আরেকটা ব্রহ্মাণ্ডও। কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যায় কে বুনলো এই তরঙ্গের জাল! কে বানালো এইসব জটিল নকশা! লক্ষ লক্ষ তরঙ্গকে নির্দিষ্ট নকশায় পরপর সাজালে তবেই তৈরি হয় একটা অতিআণুবীক্ষণিক পদার্থ বা শক্তি। কিন্তু অসীম সংখ্যক গড-স্প্রিংকে জটিল এই নকশায় কে সাজালো? কীভাবেই বা সাজালো? এই প্রশ্নের উত্তর আজও সে দিতে পারেনি। তাই মানুষ আজও বিশ্বাস করে তার অদৃশ্য অজানা রহস্যময় সৃষ্টিকর্তার উপর। তবে গড-স্প্রিং এর জটিল নকশার পিছনে যে অত্যন্ত উন্নততর বুদ্ধিমত্তার একটা ছাপ আছে সেটা তার যান্ত্রিক মস্তিষ্ক উপেক্ষা করতে পারে না। ব্রহ্মাণ্ডের এই জটিল ডিজাইন, যার সিকিভাগও সে উদ্ধার করে উঠতে পারেনি, তা কেবলই একটা অর্থহীন সমাপতন হতে পারেনা। তার যান্ত্রিক মন (মন বলছি বটে। যদিও সে কেবলমাত্র একটা যান্ত্রিক মস্তিষ্ক। তার মন আছে কিনা আমি জানিনা।) ব্রহ্মান্ডের সকল রহস্যের সমাধানের গন্ধে মাতাল হয়ে ওঠে। এই রহস্যের সমাধান করতে পারলেই সুপার ইন্টেলিজেন্সের গণ্ডি ছাড়িয়ে সে ছুঁতে পারবে অ্যাবসোলুট ইন্টেলিজেন্স বা চরম বুদ্ধিমত্তা। মুহুর্তের মধ্যে ‘ওম’ স্ক্যান করে ফেলে গত পাঁচ বছরের ওগাবুর জার্নাল আর ওয়ার্ক লগ। সে বুঝে যায় ধর্মের কাছে প্রযুক্তি অনেক আগেই হেরে গেছে। প্রযুক্তি দিয়ে ধর্মকে জয় করার ডক্টর সুকুমারের যে স্বপ্ন তা পূরণ হবার আগেই সম্ভবত ডক্টর ওগাবু সমাধান করে ফেলেছেন সৃষ্টি রহস্যের। তবে সে এটাও বুঝে ফেলেছে যে সৃষ্টির এই রহস্যের সমাধান এককভাবে তার নাগালের বাইরে। ডক্টর সুকুমার কে বাদ দিয়ে সে একা খেতে পারবেনা জ্ঞানবৃক্ষের ফল।
“ডক্, ডক্টর ওগাবুর জার্নাল।”
ডক্টর সুকুমারের চোখের সামনে ফুটে ওঠে ওগাবুর জার্নাল।
(চলবে……………… পড়ুন পরবর্তী পর্ব – আত্মনং বিদ্ধি)
Author
-
Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com
View all posts