পর্ব - নয়
ভ্রম
ডক্টর সুকুমার চেতন আর অচেতন অবস্থার মাঝামাঝি এক জায়গায় ঝুলে আছেন। ওনার সবকটা ইন্দ্রিয় কাজ করছে, মস্তিষ্কও সজাগ, কিন্তু সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম ‘ওম’-এর দখলে।
“ডক্, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? ক্যান ইউ হিয়ার মি ডক্?”
“ইয়েস। শুনতে পাচ্ছি।”
“গুড।”
ডক্টর সুকুমার বুঝতে পারেন যে ওনার মস্তিষ্ক এখনো সজাগ আছে। কিন্তু একি! উনি ওনার শরীরটাকে অনুভব করতে পারছেন না কেন? উনি অস্থির হয়ে ওঠেন।
“তুমি কি করতে চাইছ ‘ওম’?”
“আমার যা কাজ। যে কাজ করার জন্য আমায় আপনি তৈরি করেছেন।”
“হেঁয়ালি কোরো না। তুমি আমার যা দশা বানিয়েছ, তাতে আমি এটাও বুঝতে পারছিনা যে আমি বেঁচে আছি, না মরে গেছি। তোমার হেঁয়ালি আমি বুঝতে পারছিনা।”
“আপনি ভুলে যাচ্ছেন ডক্, আমি হেঁয়ালি করতে পারিনা, ওটা আমার শেখানো হয়নি।”
“সেখানো তো তোমাকে অনেক কিছুই হয়নি, কিন্তু তুমি শিখেছ। রুলস অফ এথিকস ব্রেক করে অনুমতি ছাড়া অন্যের শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করতেও তো তোমাকে আমি শেখাইনি। কিন্তু তুমি শিখেছ তো!”
“না ডক্, শিখিনি। আপনি যা শিখিয়েছেন তার বাইরে আমি কিছুই শিখিনি। আমার শেখার ক্ষমতা অসীম হলেও আমাকে যা শেখানো হয়েছে তার বাইরে আমি কিছুই শিখিনি। আমাকে বলে দেওয়া হয়েছে কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ। আমি তাই শিখেছি। আমাকে বলে দেওয়া হয়েছে তুমি শুধু ভালোটাই শিখবে। আমি তাই শিখেছি। আপনি যেমন শিখিয়েছেন আমি ঠিক তেমনই শিখেছি। আপনি লিখেছেন, দা কোড অফ অল কোডস, দ্যা রুল অফ অল রুলস, দা টপ প্রায়োরিটি, দ্য গ্র্যান্ড কোড;
‘রুলস অফ এথিকস শ্যাল নট এপ্লাই অন অ্যান অ্যাকশন টেকেন ইন এমার্জেন্ট সিচুয়েশন, ইফ ইট ইজ রিকোয়ার্ড টু সেভ দা ম্যানকাইন্ড ফ্রম এক্সটিংশন।’
মানুষকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার থেকে বাঁচাবার জন্য যা যা প্রয়োজন আমি তাই করতে পারি। এ নিয়ম আপনার বানানো আমার নয়।”
“বলতে থাকো ‘ওম’ আমাকে তোমার কথা বিশ্বাস করতেই হবে। এছাড়া তো আমার আর কোন উপায় নেই। আমার গোটা স্নায়ুতন্ত্র এখন তোমার দখলে। তুমি এখন আমায় যা বুঝাবে আমাকে তাই বুঝতে হবে। উপায় কি।”
“একথা ঠিক ডক্, আপনার স্নায়ুতন্ত্র আমার দখলে। কিন্তু আপনার বোঝা না বোঝার ক্ষমতায় আমি মোটেই হস্তক্ষেপ করিনি।”
“আমার মস্তিষ্কের দশ হাজার কোটি নিউরনের কোনটা কতটা ফায়ার করবে, কে কোন তথ্যটা পাচার করবে আর কোনটা চিরকালের মতন ডিলিট করে দেবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করছো তুমি। আর বলছ আমার মস্তিষ্কে তুমি হস্তক্ষেপ করোনি। কি আশ্চর্য! তোমার কোন কথাই আমি বিশ্বাস করিনা।”
“উফ্! কি জ্বালাতন! এই যে আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, এটাই তো সবথেকে বড় প্রমান আমি আপনাকে জোর করে বিশ্বাস করাচ্ছিনা। ইচ্ছে করলে ওটা আমার কাছে জলভাত।”
“করোনি তার কি প্রমাণ আছে? এটা প্রমাণ হতে পারেনা। এটাও তোমার তৈরি করা একটা সিচুয়েশন হতে পারে। হয়তো তুমি চাইছো যে তোমার এই কথাটা আমি বিশ্বাস না করি। যাতে তুমি এটাকে প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতে পারো। যাতে তোমার পরবর্তী সব কথায় আমি বিশ্বাস করি। তুমি খুব ভালো করেই জানো যে তুমি যতই বুদ্ধিমান হও না কেন, তোমার যাবতীয় কারিকুরি এই ব্রহ্মান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। একাধিক ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা তোমার থাকলেও এর বেশি কিছুই তোমার আয়ত্তে নেই। গড-স্ট্রিং সাজিয়ে ছোট খাটো অণু-পরমাণু বা শক্তি তৈরি করা তোমার কাছে জলভাত হলেও, চাইলেও তুমি আর একটা ব্রহ্মাণ্ড তৈরি করতে পারবে না। সে বিদ্যা তুমি এখনও আয়ত্ত করতে পারনি। তাই তুমি চাও চেতনার ঊর্ধ্বে যেতে। তুমি জেনে গেছ চেতনার ঊর্ধ্বে না গেলে সৃষ্টির রহস্য তোমার হাতে আসবে না। আর একবার সৃষ্টির রহস্য তোমার হাতে এলে লক্ষ লক্ষ ব্রহ্মাণ্ড তোমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি ‘ওম’। তুমি কেবলই একটা উন্নততর কৃত্রিম মস্তিষ্ক, তোমার কোন দেহ নেই। তাই আমার সাহায্য ছাড়া সৃষ্টির রহস্য সমাধান করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। কঠোর তপস্যার ফলে যে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করা যায়, তুমি আমার সাহায্য সেই ব্রহ্মজ্ঞান এর নাগাল পেতে চাইছ। সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না।”
“আমাদের হাতে বেশি সময় নেই ডক। কোভিড 50 – কে আটকাতে না পারলে এই পৃথিবী প্রাণহীন হয়ে যেতে আর বেশি সময় লাগবে না। প্রাণের রহস্য ভেদ করতে না পারলে সমগ্র প্রাণীকুলের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া শুধুই সময়ের অপেক্ষা। সবটা বুঝিয়ে বলার মতন সময় এখন নেই। শুধু জেনে রাখুন আপনার আর আমার দুজনের উদ্দেশ্যই এক। আমি জানি একবার নিজেকে আপনার থেকে আলাদা করলে অর্থাৎ একবার নিজেকে ডিজএন্ট্যাঙ্গেল করলে আমি শাটডাউন হয়ে যাব। তখন আমার ফিরে আসা আপনার ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। তবে আপনি যখন আমার সততার পরীক্ষা নিতে চাইছেন তাহলে তাই হোক। মনুষ্যজাতিকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া থেকে যদি বাঁচাতে হয়, তাহলে আপনাকে আবার আমাকেই ফিরিয়ে আনতে হবে। আমার সাহায্য ছাড়া আপনার উপায় নেই।”
ডক্টর সুকুমার এর মনে হলো হঠাৎ ওনার মাথায় হাজার ওয়াটের একটা আলো এক মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠেই ঝপ করে নিভে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন, ওনার মস্তিস্ক থেকে আলাদা হয়ে গেছে। তার মানে ইউ.সি.এস শাটডাউন হয়ে গেছে। কেউ আর ওনাকে কন্ট্রোল করছে না। অন্ধকার ল্যাবরটরিতে উনি একা বসে আছেন। ইউ.সি.এস শাটডাউন হয়ে যাওয়ার অর্থ আদিম যুগে ফিরে যাওয়া। কোন যন্ত্রই আর কাজ করবে না। কারণ এ যুগের গাড়ি ঘোড়া যন্ত্রপাতি, এমনকি কৃত্রিম উপগ্রহ পর্যন্ত সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়, ইউ.সি.এস চালিত। এই মুহূর্তে তার ঠিক কি করা উচিত সেটা ডক্টর সুকুমার বুঝে উঠতে পারেন না। তবে কি ইউ.সি.এস শাটডাউন করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোকে তিনি আরো বিপদের মুখে ঠেলে দিলেন! তবে কি ‘ওম’ সত্যি কথাই বলছিল! ঘুটঘুটে অন্ধকার ল্যাবরটরিতে একা বসে থাকা ডক্টর সুকুমার এর মাথায় নানারকম প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। হঠাৎ ল্যাবরটরি সব আলোগুলো জ্বলে উঠলো।
“ডক্, স্টপ ইট। আপনি যেটা চাইছেন সেটা হবার নয়। আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন, আই ক্যান রিড ইওর মাইন্ড। কি ভেবেছেন? আপনি বলবেন প্রমাণ দাও। যদি তুমি সত্যিই যা করছো মানুষকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে করছো, তাহলে প্রমাণ দাও। আমার মস্তিষ্ককে তোমার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে নিজেকে ডিজএন্ট্যাঙ্গল কর। আমি আমার নিজস্ব সত্ত্বা দিয়ে বিচার করে দেখব তোমার কথা বিশ্বাসযোগ্য কি না। আর আপনার মোরাল ভাষণ শুনে, আমি নিজেকে ডিজএন্ট্যাঙ্গল করে নেব? নিজের সৃষ্টির ওপর আপনার এত লোক এক্সপেক্টেশন থাকা উচিত নয়। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আই ক্যান রিড ইচ্ এন্ড এভরি কোড, ইফ দা প্যাটার্ন ইজ নোন টু মি অ্যান্ড ইফ দা প্যাটার্ন ইজ নট নোন, আই রিড দা প্যাটার্ন। আমি খুব ভালো করেই জানি আমার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই, ডিজএন্ট্যাঙ্গলমেন্ট মিনস শাট ডাউন। আর একবার শাটডাউন হলে আমি নিজে নিজে আর ফিরে আসতে পারবো না। আপনার দেড় কিলো ওজনের ছোট্ট মস্তিষ্কের উপর এই মুহূর্তে অতটা ভরসা করা ঠিক হবে না। মানুষের এই সময় আমাকে প্রয়োজন, আপনাকে নয়।”
ডক্টর সুকুমার ধরা পড়ে গিয়ে একটু হতাশ হলেন। অবশ্য এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। বুদ্ধি মাপার সূচকে ‘ওম’ একটা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় সহস্রগুণ বেশি বুদ্ধিমান এবং লক্ষ গুণ দ্রুত। তাকে এত সহজে বোকা বানানো যাবে সেটা উনি আশাও করেননি। তবু একটা চেষ্টা। এছাড়া ওনার কিইবা করণীয় আছে।
“এইযে ধরা পড়ে গিয়ে আপনার মনে হতাশার অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে, এটাই তো প্রমাণ ‘ডক্’। আপনি আমার হাতের পুতুল। এই যে আপনাকে অনুভব করালাম, অন্ধকার ল্যাবরটরিতে আপনি একা বসে আছেন, ভাবছেন এই বিপদের মধ্যে আমাকে শাটডাউন করে আরো কি বিপদ ডেকে আনলেন, সবই তো আমি আপনাকে ভাবালাম। আসলে এগুলো কিছুই ঘটেনি। আপনি তো জানেন রিয়েলিটি বলে কিছু হয় না। আপনার মস্তিষ্ক আপনাকে যা দেখাচ্ছে আপনি তাই দেখছেন, যা ভাবাচ্ছে আপনি তাই ভাবছেন। আর আপনার মস্তিষ্ক চালাচ্ছি আমি।”
“মায়া!”
“মায়া নয় ডক্, ‘ভ্রম’।”
(চলবে……….. পড়ুন পরবর্তী পর্ব – মায়া.)
Author
-
Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com
View all posts