গল্প: “কী করে আমাদের মেয়ের নাম নন্দিনী হলো?” লিখেছেন, রোদ্দুর অরিত্র।

a girl writing in front of laptop
কি করে মেয়েটার নাম নন্দিনী হল? অনেকটা অতীত আর খানিকটা বর্তমান মিশিয়ে একটা অসাধারণ কল্পকাহিনী রচনা করেছেন, লেখক, রোদ্দুর অরিত্র। খবরে বলছে, ভাঙ্গতে চলেছে অংশুল রায় ও অতসী রায়ের ২৫ বছরের সংসার। কিন্তু তার সাথে মেয়েটার নামের কি সম্পর্ক সেটা জানতে হলে পড়তে হবে পুরো গল্পটা।

Share This Post

অতসী, 

কেমন আছো? অনেকদিন দেখা হয়নি তোমার সঙ্গে। অনেকদিন কোন গল্পও শোনানো হয়নি তোমায়। হয়তো তোমার প্রয়োজন ছিলনা শুনবার। আজ তোমাকে একটা গল্প শোনাব। কী করে আমাদের মেয়ের নাম নন্দিনী হল, সেই গল্পটা শোনাব তোমায়।

 

আচ্ছা তোমার মনে আছে আমাদের টি.এস.সি. -তে হেঁটে বেড়াবার দিনগুলোর কথা? যখন তুমি আমি ঠিক করেছিলাম আমাদের মেয়ের নাম রাখবো নন্দিনী।  তখন আমার হাতের ফুলে থাকা মাংসপেশিগুলো বুঝিয়ে দিত সদ্য কলেজ পেরিয়েছি। আর তুমি তো চিরকালই উপন্যাসের নায়িকাদের মতো সুন্দরী। টি.এস.সি. -তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকা সবাই একবার করে ফিরে তাকাতো যখন আমরা হেঁটে যেতাম।  আমরা তখন স্বপ্ন দেখতে প্রচন্ড ভালোবাসতাম। তাই না? গল্প বানানো ছিল আমাদের বিলাসিতার নাম। তখন আমরা ভয় পেতে শিখিনি। জীবনটাকে দেখতাম আমাদের পরিকল্পনার ছাঁচে সাজানো সুন্দর এক ছবি হিসেবে। অবশ্য ভয় পাবোই বা কেন? ভালোবেসে যারা বিপ্লবী হয়েছিলাম তাঁদের আবার ভয় কিসের? আমি তখন পড়ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রিয় বিষয় নিয়ে, আর সেইসঙ্গে চলছিল খানিকদূরের মেডিকেল কলেজে তোমার এম.বি.বি.এস এর পাঠ । আমাদের স্বপ্নে খুব বাড়াবাড়ি ছিল বললে ভুল হবে। পড়াশোনা শেষে একটা ভালো চাকরি আর তোমার সাথে ঘর বাঁধা। খুব কি দূরের কিছু ছিল? ছিল না তো! কিন্তু কে জানতো পৃথিবীর সহজ পরীক্ষার প্রশ্নও কখনো কখনো কমন পরেনা।

 

সেই সন্ধ্যাটা আমার এখনো মনে আছে। আমার জীবনের সেরা সন্ধ্যা ছিল ওটা। আমাদের প্রিয় গায়কের স্টেজ শো ছিল আমাদের শহরে। আমি জোগাড় করেছিলাম সবচেয়ে সামনের সারির টিকেট যেখান থেকে আমাদের স্বপ্নের গায়ক ছিল কেবল হাত ছোঁয়া দূরত্বে। আমরা মুগ্ধ হয় শুনছিলাম গান। তোমার মাথা ছিল এই আমার কাঁধে, কিন্তু আমি কি সেদিন জানতাম আমাদের প্রিয় গায়ক, যে আমাদেরকে দেখছিল আর বোধহয় আমার ওপর খানিকটা হিংসে করছিল! 

সেই কন্সার্ট শেষে দুজন দুজনার হলে, তুমি বলেছিলে কাল আবার দেখা হবে। শহীদ মিনারের ওখানটাতে ঠিক বিকেল ৫ টায়। আমি পৌঁছেছিলাম সেখানটাতে ঠিক চারটে আটান্নতে। কিন্তু তুমি ৭ টা ৫৮ তেও এলেনা। আমার ৫৮ খানা ফোন, ৭৭ খানা sms আর ৬৮ খানা মেসেজের কোন উত্তর আজ অবধি পাইনি। সেদিন ভেবেছিলাম হয়তো কোন কাজে আটকে গেছ। সেদিন কি আর জানতাম কোথায় আটকেছ তুমি। 

 

এরপর তোমায় আমি আবিষ্কার করি খবরের কাগজের বিনোদন পাতায়। সেদিন থেকে তো ওখানেই প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করেছি তোমায়। বিখ্যাত গায়ক অংশুল রায়ের সঙ্গে গাটছাড়া বাঁধতে যাচ্ছ তুমি। শুনে খুশিই হয়েছিলাম। সেই খুশিতে পুড়িয়েছিলাম সেদিনের তুমিময় সব পত্রিকা। 

 

সেসব দিনের আজ ২৫ টা বছর পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে আমার কোন খবর তুমি হয়তোবা পাওনি খবরের কাগজের কলাম পড়বার সময় কোনদিন তোমার হয়েছে বলে মনে হয় না। হয়ে থাকলে আমার নামখানা চোখে পড়েও থাকতে পারে। 

সেদিন আমি কি হারিয়েছিলাম জানিনা। তবে তুমি হারিয়েছিলে ভালোবাসার একজন মানুষকে। যে শুধু তোমাকে ঘিরে বাঁচতে চেয়েছিল। তুমি হারিয়েছিলে মিসেস রায় নামের ঠুনকো গ্ল্যামারের খোলশে আসল তুমি কে, যে তুমি আমার কাছে নিজের পায়ে দাঁড়াবার প্রত্যয় করেছিলে। এক ইন্টারভিউতে শুনেছি সংসার সামলানোর তাগিদে এম.বি.বি.এস টা আর তোমার হয়ে ওঠেনি। জানি না তোমার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে  কতটা কি পেয়েছ। আচ্ছা তোমার গানের গলাটাও তো কম ছিল না! তুমি কি আর কখনো গাইবার চেষ্টা করেছ? সময়টা পাওনি বোধহয়। হয়তো বা গেয়েছ কোন সন্ধ্যার ঝলমলে পার্টিতে অনেকের অনুরোধে, “এই বৌদি আপনি একটা ধরুন না …” তুমি হয়তো তখন শুনিয়েছ খানকয়েক গান, প্রশংসাও পেয়েছ। কিন্তু এমন ‘তুমি’ কি তুমি হতে চেয়েছিল? পুরনো তুমিটাকে কোথায় দিয়েছ সমাধি? কি লিখেছ পুরনো তুমির এপিটাফে? তুমি যে আমার কাছ থেকে সেদিন কেড়ে নিয়েছিলে সব, আমার বাইরের জগত, আমার কবিতার খাতা, আর কেঁড়ে নিয়েছিলে বিশ্বাস করবার ক্ষমতা। 

সেদিন থেকে নিজেকে বন্ধ করেছিলাম এক অন্ধকার ঘরে। ক্লাস নোট আর বই খাতার ভাজে। শেষঅব্দি নিজেকে আবিষ্কার করলাম সর্বোচ্চ সিজিপিএধারী শিক্ষার্থীর জায়গায়। দেখলাম আমি দাঁড়িয়ে আছি বন্ধুবান্ধবহীন, সম্বলহীন এক বিস্তীর্ণ অজানা দ্বীপে সেদিনের খবরের কাগজে দেখেছিলাম একটা সংবাদ মা হতে চলেছ তুমি। 

 

এভাবেই কেটেছে ২৫টা বছর। এখন আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২০০০ ছেলে মেয়ের পিতৃসম। ওদের হাজারটা অসুবিধার এক ভরসার জায়গা আমি। কিন্তু ওরা বোধহয় জানে না আমি ভরসা করতে ভুলে গেছি। খবরের কাগজে আজকাল তোমাকে বা গায়ক মশাইকে কাউকেই দেখা যায় না। কিন্তু সেদিন হঠাৎ আরেকটা খবরে চোখ আটকালো … “ভাঙ্গতে চলেছে অংশুল রায় ও অতসী রায়ের ২৫ বছরের সংসার।” খুব স্বাভাবিক ঘটনাই হয়তো এটা তোমাদের জগতে। কে পেলে শেষে? কি হয়ে বাঁচবে এখন? কি নিয়ে বাঁচবে? বাঁচার জন্যে স্বপ্ন লাগে। আর স্বপ্ন নামক বস্তুটিকে তো তুমি গলা টিপে মেরেছ অনেক আগেই।  নাকি এখনো বেঁচে থাকার লড়াই করবে? মিসেস রায় হয়ে বেঁচে থাকার জন্যে? 

এখন বলবে কী সব আবোল তাবোল বকছো? যে গল্পটা বলতে চেয়েছিলে সেটা বলো। আরে বাবা আমি বুড়ো প্রফেসর সারাদিন বকতে বকতে বকাটাই তো স্বভাব। 

তখন ডিপার্ট্মেন্টে এডমিশনে সিজন। খুব ভিড়। এমন সময় একটা মেয়ে এসে আমায় বললো, “একটা ভর্তির ফরম দিন।” 

বললাম, “সময় তো প্রায় শেষের দিকে। এখনই বসে ফরম খানা ফিলাপ করে ফেরত দাও।”

 

সে খুব দ্রুত ফরমখানা ভর্তি করে দিল মুক্তোর মত হাতের অক্ষরে। ফরমখানা ফিরিয়ে নিয়ে দেখলাম, বাবার নামের জায়গাটা খালি রেখেছে। নিজের নাম লিখেছে নন্দিনী। আর মায়ের নাম অতসী সেন।

বুঝতে পারলে তো, কী করে আমাদের মেয়েটার নাম নন্দিনী হলো?

✍️রোদ্দুর অরিত্র।

Author

  • রোদ্দুর অরিত্র

    লেখকের জন্ম ২০০৩ সালে। চিকিৎসক বাবা আর এন.জি.ও এর প্রাক্তন কর্তা মায়ের বড় ছেলে রোদ্দুর বর্তমানে পড়াশোনা করছে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে। সাহিত্যের সঙ্গে ওঠাবসা ক্লাস নাইন থেকে। দায়িত্ব পালন করছে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের কলেজ সাংস্কৃতিক অধিনায়ক হিসেবে। লেখকের ভালো লাগে গোধূলির রং, বন্ধুদের আড্ডা আর গান।

    View all posts

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore