আমাকে আপনারা চিনবেন না। অবশ্য একেবারে হলফ করে বলা যাবে না। চিনতেও পারেন। এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর যুগে, যে কেউ যে কাউকে চিনতে পারে। কিন্তু আমি আমার প্রাইভেসি রক্ষা করার যথাসম্ভব চেষ্টা করব। তার পরেও আপনাদের মধ্যে থেকে কেউ যদি আমাকে চিনে ফেলেন, তার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, দয়া করে আমার আইডেন্টিটি রিভিল করবেন না। আসলে আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, যা আমার দুনিয়াটাকে ওলট পালট করে দিয়েছে।
আপনাদের মধ্যে থেকে কে কে আমাকে চেনেন, আর কে কে চেনেন না, সেই বিবাদে না গিয়ে, যারা চেনেন না তাদের জন্য বলে রাখি, মানুষ কিন্তু আমি মোটেই এলেবেলে নই। আমি হচ্ছি গিয়ে, যাকে বলে কেউকেটা। সমাজে পন্ডিত হিসেবে আমার যথেষ্ট সুনাম আছে। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয় আমায় আমন্ত্রণ জানায় লেকচার দেওয়ার জন্য। তবে স্বভাবে আমি অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র এবং ভদ্র। এমনিতে আর পাঁচটা ঝাঁ-চকচকে লোকের সঙ্গে চেহারায় আমার তেমন কোন বিশেষ পার্থক্য নেই। সুতরাং আমার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন, যে আমার মতন একজন মানুষের ইন্টিগ্রিটি একটু হাই হবে। এট লিস্ট হওয়া উচিত। আমি শুধু যে অন্যায় করি না, তাই নয়, আমি অন্যায় সহ্যও করতে পারিনা। অবশ্য অন্যায় দেখে রুখে দাঁড়ানোর স্বভাবটা অনেকবার আমায় বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেছে। তবে এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স অবধি কেউ আমায় পেড়ে ফেলতে পারেনি।
হঠাৎ করে এই ঘটনাটা আমাকে ব্যক্তিত্বের সংকটের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রথমে তো ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, যে আমার সাথে এমন হতে পারে। না পারছি কাউকে বলতে। না পারছি গিলতে। এভাবে চললে অসুস্থ হয়ে পড়বো, তাই ঠিক করলাম ঘটনাটা আপনাদেরকেই বলি।
ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য আমার স্ত্রীর হাত দিয়ে। আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবন। নয় নয় করে তাও বছর কুড়ি হল। সুখী দাম্পত্য জীবন মানে ধরে নিন একেবারে পারফেক্ট অ্যাপিয়ারেন্স। এবারে চার দেয়ালের ভিতরে কি হচ্ছে সেটা তো আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। ওটা তো আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার শোবার ঘরে আমাকে আমার বউ গালাগাল করছে, নাকি কেলাচ্ছে, সেটা একেবারেই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ জানতে না পারলেই হলো। জানতে অবশ্য পারছেও না। কারন আমি এসব কথা কাউকে বলিনা। আপনাদের বলছি, সে কথা অন্য। আপনারা তো আর আমাকে চেনেন না।
যাই হোক যেটা বলছিলাম, আমার স্ত্রী শ্রীমতি সরখেল (এটাকে আবার আসল পদবি ভাববেন না), কয়েকদিন আগে কলকাতার একটি নামি রিটেল চেন স্টোর থেকে, একখানা কাটলারি সেট কিনেছেন। রিটেল চেন স্টোর টিকে আপনারা সকলেই চেনেন। তাই নামটা আর বলছি না। নামকরা কোম্পানি। জিনিসটার দাম খুব বেশি নয়, ওই হাজার খানেকের মধ্যেই। তবে গোলমালটা অন্য জায়গায়। বাক্সের মধ্যে থাকার কথা, পাঁচটা কাঁটাচামচ, তিনটে বড় ছুরি, দুটো ছোট ছুরি, পাঁচটা বড় চামচ, তিনটি ছোট চামচ, তিনটে সুপ খাওয়ার চামচ, আর এই সমস্ত জিনিস গুলো সাজিয়ে রাখার জন্য একটা কাঠের কারুকার্য করা স্ট্যান্ড। এবার শ্রীমতি সরখেল বাক্স সমেত জিনিসটি কিনেছেন। বাক্সটি খুলে দেখেন নি। বাক্স বন্ধ অবস্থায় বিল করেছেন। উনি বাড়িতে ফিরে বাক্স খুলে দেখেছেন সবই আছে, কিন্তু ওই কাঠের স্ট্যান্ডটা নেই। কি আশ্চর্য। শ্রীমতি সরখেলের সঙ্গে চিটিংবাজি। দ্য ওয়ার্ল্ড ফেমাস মিস্টার সরখেলের বেটার হাফ এর সাথে চিটিংবাজি। বেগতিক দেখে, প্রথমে আমি ব্যাপারটা অন্যভাবে ডিল করতে চেষ্টা করেছিলাম। কারণ কেনাকাটার ব্যাপারটা শ্রীমতি সরখেল করলেও, কোন এক অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী, পাল্টাপাল্টির ব্যাপারগুলো আমাকেই করতে হয়। তাই আমি বললাম, ‘আরে বাবা ওরকম হয় নাকি। বাক্সে ওই কটা জিনিসই থাকার কথা। দু হাজার টাকায় তোমায় একুশটা স্টেইনলেস স্টিলের চামচ দেবে, আবার সঙ্গে কাঠের কারুকার্য করা স্ট্যান্ডও দেবে? পাগল নাকি।’
শুরুতেই পেনাল্টি। উত্তরে শুনতে হল,
‘যা জানো না সেটা নিয়ে কথা বলতে আসো কেন? আমি তোমার মতন তালকানা নই। ভেতরে কি কি থাকার কথা সেটা বাক্সের উপর লেখা আছে।’
এই তালকানা মালকানা কথাগুলো না, শুনলেই একেবারে গা পিত্তি জ্বলে যায়। তাই বলে ফেললাম,
‘কেনার সময় কি তোমার ওই পটলচেরা চোখ দুটোতে পর্দা ফেলা ছিল নাকি? তাছাড়া অত বড় একটা বাক্সের ভিতর, ঢকঢক করে কতগুলো ছন্নছাড়া চামচ ঝনঝনিয়ে নড়ছে, সেটা তো হাতে ধরলেই টের পাওয়া যায়।’
খেলা অবশ্য দ্বিতীয় রাউন্ডেই শেষ। এরপর কিছু বললেই বলতাম, ‘যা গন্ডগোল নিজে পাকিয়েছো, দরকার হলে নিজে গিয়ে চেঞ্জ করে আনোগে যাও। খবরদার যদি আমাকে বলতে এসেছ।’
দরকার অবশ্য হয়নি। শ্রীমতি সরখেল নিজেই কল করেছেন কাস্টমার কেয়ারে। ফোনে যথেষ্ট উত্তেজিত কথাবার্তা চলছে। দু-একটা কথার টুকরো সাঁই করে কানে ঢুকে যাচ্ছে।
‘হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট?….. ইট ইস ইওর রেস্পন্সিবিলিটি টু সি।……. ইট ইস ইওর ফল্ট….. ইফ আই গো টু কনজিউমার কোর্ট, ইউ উইল হিয়ার দা মিউজিক।’
আমি আর মাথা লাগালাম না। শেষমেষ কি হবে জানি। ওরকম খালি বাক্স, ঢকঢক করছে, কেউ কেনে নাকি! আরে বাবা আমি বাক্স সমেত কিনলাম। দোকানে একবারও বাক্স খুলে দেখলাম না। পরে বাড়ি গিয়ে বললাম বাক্সর ভেতরে মাল নেই। এটা দোকানদার মানবে কেন? এই কেসে চেঞ্জ করতে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ছুটকো সেলসম্যান দু চার কথা শুনিয়ে দেবে। ওসব আমার পোষায় না।
যাই হোক। ফোনা ফুনিতে যা হবার তাই হল। কাস্টমার কেয়ার থেকে জানিয়েছে, ওরা সিসি টিভিতে পুরোটা দেখেছে। শ্রীমতি সরখেল বাক্স সমেত তুলেছেন, বিল করেছেন এবং বেরিয়ে গেছেন। বাক্স খুলে দেখার দায়িত্ব ক্রেতার। বিলিং এজেন্টের কোন দায়িত্ব নেই সমস্ত বাক্স খুলে খুলে দেখার, যদি না সেটা বিল করার জন্য প্রয়োজন হয়। সুতরাং বাড়ি গিয়ে বাক্স খুলে দেখলাম, বাক্স ফাঁকা, এমন দাবি ওরা মানবে না।
যাবতীয় হুমকি বিফলে যাওয়ার পরে, শ্রীমতি সরখেল চুপ করে বসে আছেন। যারা জীবন্ত আগ্নেয়গিরি সামনে থেকে দেখেছেন, তারা জানেন, অগ্নুৎপাত হবার কিছুক্ষণ আগে থেকেই অনেক প্রাণী টের পায়, এই বুঝি লাভা ছিটকে বেরোতে শুরু করলো। এই অগ্নুৎপাত ব্যাপারটিকে আমার মত নিরীহ প্রাণীরা তাই যথেষ্টই ভয় পায়। আমি থমথমে পরিস্থিতিটা হালকা করার জন্য বলেছিলাম,
‘আরে বাবা, দা ডক্ট্রিন অফ, ক্যাভিয়েট এম্পটর, শোনোনি? ক্যাভিয়েট এম্পটর মানে হল, বায়ারস্ বিওয়্যার। অর্থাৎ যে কিনছে, তার দায়িত্ব, দেখে, শুনে, বুঝে কেনা।’
আবার কেস খেলাম। কি জন্য বললাম, আর ফল কি হলো। উল্টে শ্রীমতি গেলেন বাম্পার খচে। ফলে আমার দিকে গোলাগুলি যা আসতে লাগলো, তার দু একটা নমুনা আপনাদেরকে শোনালেই আপনারা বুঝবেন আমার অবস্থাটা। স্টেডি গলায়, খুব বেশি উচ্চস্বরেও নয়, আবার খুব নিচু গলায়ও নয়, শ্রীমতি সরখেল বাড়ির সমস্ত কাজ ঘুরে ঘুরে করতে লাগলেন, আর বিড়বিড় করতে লাগলেন। ছোটবেলা মাকে দেখেছি এইরকম একটা নির্দিষ্ট রিদম মেনে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়তে। অনেকটা ঠিক সেইরকম। শুধু এখানে শ্রীমতি, লক্ষ্মীর পাঁচালীর বদলে, আমার মুণ্ডপাত করছেন।
‘লেকচার মেরে বেড়ায়। লোম নেই কুত্তার, নাম তার বাঘা। আবার বলে নাকি, হাই ইন্টিগ্রিটি। কথায় কথায়, অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা যেন তারে, তৃণ সম দহে, আওরাচ্ছে। বাঘের বাচ্চা টমি। খালি মুখে বড় বড় বুলি। কম্পিউটার থিংকিং এর উনি পন্ডিত (আসলে কম্পিউটেশনাল থিংকিং হবে)। বড় বড় প্রবলেম নাকি উনি সলভ করেন। এদিকে সত্তিকারের প্রবলেম দেখলে ওনার ওইটা শুকিয়ে যায়। পুরুষসিংহ। সিংহ বাবাজির দৌড় আমার জানা আছে। যতসব অপদার্থ দুমুখো সাপ। আরে তোর মুরোদ নেই, চুড়ি পড়ে বসে থাক ঘরে। দুনিয়াজুড়ে লেকচার মেরে বেড়ানোর কি আছে। অবশ্য যার চল্লিশ বছর হতে না হতেই ইরেকটাইল ডিসফাংশন হয় তার থেকে এর বেশি কিছু আশা করা যায় না। সোশ্যাল ওয়ার্ক করেন। সমাজে চেঞ্জ আনবেন। এদিকে প্রদীপের তলায় অন্ধকার।’
যত রকমের, ভাষা নির্বিশেষে, প্রবাদ বাক্য আছে, তার সবকটাই যে আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়, সেটা শ্রীমতীর থেকে আর কেউ ভালো জানে না। যাই হোক। সবটা না হয় আপনাদের নাইবা বললাম। এসব আমার এক্কেবারে পার্সোনাল ম্যাটার। এই অবিরাম অনবরত গোলাবর্ষণ চলল রাত দুটো পর্যন্ত। শ্রীমতি সরখেল ঘুমিয়ে পড়লেন রাত বারোটায়। অবাক হচ্ছেন তো? বারোটায় ঘুমিয়ে পড়লে দুটো অব্দি উনি গোলাবর্ষণ করলেন কি করে? ওটা ওনার জন্মগত প্রতিভা। উনি ঘুমিয়ে পড়ার পরে সিস্টেমটা অটোমেটেড হয়ে যায়। ভাবা যায়! একটা মানুষ ঘুমিয়ে পড়ার পরেও দু’ঘণ্টা বিড়বিড় করে স্বামীর মুন্ডুপাত করতে পারে। এটাকে জন্মগত প্রতিভা ছাড়া আর কি বলব বলুন। অবশ্য আপনাদের সবার এক্সপিরিয়েন্স একই রকম কিনা আমার জানা নেই।
রাত দুটোয় যখন শ্রীমতীর ঠোঁটদুটো নড়া বন্ধ হল, ততক্ষনে আমার ঘুম চটকে গেছে। আমি উঠে গিয়ে এক কাপ কফি বানালাম। রাতের এই সময়টা আমার বরাবরই খুব প্রিয়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, শুধু আমি জেগে আছি, এই ব্যাপারটা আমায় একটা অদ্ভুত এনার্জি দেয়। সারা জীবনে আমি যত জটিল সমস্যার সমাধান করেছি, সবই এই সময়। ওই কথায় আছে না, সর্দারজিদের রাত বারোটায় মাথায় কি সব হয়। সেই রকম আমার রাত দুটোর পরে মাথা খুলে যায়। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম, শ্রীমতীর মাথা গরম হওয়ার কারন যথেষ্টই আছে। ন্যায় অন্যায় বিচার করলে, শ্রীমতিই অন্যায়ের শিকার। পুরো দাম যখন দিয়েছে, তখন পুরো জিনিস পাওয়ার অধিকার তার আছে। সে দিক থেকে দেখলে ঠিকই আছে। অন্যদিকে, অপর পক্ষের পাল্লাও যথেষ্ট ভারী। জিনিসটা দেখে নেওয়া উচিত ছিল। সিসিটিভি দেখেও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কোন পক্ষই প্যাকেটটা খোলেনি। শ্রীমতিরই উচিত ছিল দেখে নেওয়ার। কোম্পানি থেকে অর্ধেক জিনিস প্যাকেট হয়ে আসার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। এটা হতে পারে যে স্টোরের কোন কর্মচারী কোন কারনে প্যাকেট খুলে স্ট্যান্ডটা বার করে নিয়ে আবার প্যাকেটটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখেছে। আর শ্রীমতি না দেখে সেই প্যাকেটটাই তুলে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে স্টোরের লোকেরা স্বীকার না করলে, কিছুই করার নেই। আরে বাবা লড়াই যে করব, উপযুক্ত যুক্তি-প্রমাণ কিছু তো চাই। এদিকে আবার আমার অস্তিত্বের সংকট। না ভুল বললাম, ব্যক্তিত্বের সংকট। সুতরাং এক কাপ গরম কফি গলাধঃকরণ করে, মধ্যরাত্রে, আমি খাতা কলম নিয়ে বসলাম, আমার ব্যক্তিত্বের সংকটের সমাধানের জন্য একটা উপযুক্ত প্ল্যান করতে।
প্ল্যানিং নিয়ে আর বেশি টেকনিক্যাল আলোচনায় যাব না। প্রথমে অপর পক্ষের সমস্ত রকম সম্ভাব্য যুক্তিগুলোকে খাতায় লিখে ফেললাম। তারপর অপরপক্ষের প্রত্যেকটা সম্ভাব্য যুক্তির বিরুদ্ধে, যুক্তির জাল বুনে একটা করে স্ট্রং আর্গুমেন্ট তৈরি করে রাখলাম। যাতে সব দিক থেকেই দেখলে মনে হয়, দোষ-ত্রুটির পাল্লাটা কোম্পানির দিকেই ভারি। আর সবকিছুর সঙ্গে একটু অসম লড়াইয়ের ইমোশন যোগ করে দেবো। শক্তিশালী কোম্পানির সঙ্গে এক অসহায় মহিলা উপভোক্তার লড়াই। সঙ্গে দুজনকে নিয়ে যাব। ওদের কাজ হবে একটু হাওয়া গরম করা। কাস্টমার কেয়ারের মহিলাটি বড্ড ক্যাটক্যাটে। কনভিন্স করতে না পারলে কনফিউজ করে দিতে হবে।
‘কেনার সময় দেখে নেননি? বাক্স টা হাতে নিয়েই তো বোঝা যাচ্ছে ভেতরে অর্ধেক মাল নেই।’
আমি অবশ্য এরকমই কিছু আশা করেছিলাম।
‘দেখে কিনলে কি আর, দু হাজার টাকার কাটলারি সেট এর জন্য অফিসের কাজ ফেলে এখানে আসতাম? তাছাড়া আমি তো ফোনে কমপ্লেন করেছিলাম। আমাকে তো আপনারাই আসতে বললেন।’
কাস্টমার কেয়ারের মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, ‘ফোনে কার সাথে কথা হয়েছিল স্যার?’
উত্তরটা আমার রেডিই ছিল, ‘কি আশ্চর্য! আপনাদের কাস্টমার কেয়ারে কে ফোন ধরেছে, সেটা তো আপনাদের জানার কথা। আমি কি করে জানব।’
‘স্যার, নামটা জেনে নেওয়া উচিত ছিল। আমি কি করে জানব কে আপনাকে ফোনে কি বলেছে’
সব প্ল্যানমাফিক এগোচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভের প্রথম কাজই হলো ফোন তুলে বলা, নমস্কার আমি অমুক কোম্পানির তরফ থেকে তমুক বলছি। আপনাদের এক্সিকিউটিভ যদি সেটা না বলে, তার দায় তো কনজিউমারের নয়।’
এই উত্তরটা মোক্ষম কাজ দিয়েছে মনে হল। মেয়েটা একটু মিইয়ে গেল মনে হচ্ছে।
‘ঠিক আছে কটা নাগাদ ফোন করেছিলেন বলুন। কল লগে দেখি কে আপনার সাথে কথা বলেছে।’
প্রশ্নটা শুনেই গলার কাছটা কেমন যেন শুকিয়ে গেল। ইস্! এটা আমার মাথায় আসেনি। যাই হোক, আমি সামলে নিয়ে একটু গলার জোর বাড়িয়ে বললাম,
‘সে কি করে বলবো। ফোন তো আমি ল্যান্ড লাইন থেকে করেছিলাম। বাড়ি থেকে।’
‘একজ্যাক্ট জানতে চাইছি না স্যার। সকাল বিকেল দুপুর মোটামুটি বললেই হবে।’
মনে মনে ভেবে নিলাম, এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটা, সকাল নটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত খোলা থাকে। সকালের যে কাস্টমার কেয়ারে বসে, সে নিশ্চয়ই রাত নটা পর্যন্ত ডিউটি করে না। আট ঘন্টার শিফট হলে, সাড়ে চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে, লোক বদল হওয়ার কথা। আমি তাই আন্দাজে বললাম,
‘ওই বিকেল সাড়ে চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই হবে।’
সঙ্গে করে নান্টু, আর মানবীকে নিয়ে এসেছি। ওরা একটু দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। যেন আমরা কেউ কাউকে চিনি না। ব্যাপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে, আমি নান্টুকে ইশারা করলাম। নান্টু আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘আরে দাদা আমারও এরকম কেস একবার হয়েছিল। এরা মাল বার করে, খালি প্যাকেট কাউন্টারে রেখে দেয়। সব সময় দেখা সম্ভব নাকি।’
পিছন থেকে মানবীও বলে উঠলো, ‘ভুল হতেই পারে বাবা। এত তর্ক করার কি আছে। ভদ্রলোক তো আর এমনি এমনি এসে বলছেন না।’
হাওয়া বেশ গরম হয়ে উঠেছে। দু’একজন আরো কাস্টমার উঁকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা কি। কাস্টমার কেয়ারের মেয়েটি আর চাপ নিতে না পেরে, ফোনে ফিসফিস করে স্টোর ম্যানেজার কি সব বলল। ওদিক থেকে কি বলেছে সেটা আমি জানতে পারিনি। কিন্তু ফোন রেখে বেজার মুখে মেয়েটি আমায় বলল,
‘ঠিক আছে দিন পাল্টে দিচ্ছি। কিন্তু এরপর থেকে কেনার সময় দেখে নেবেন।’
‘সে আর বলতে।’
খেলাটা বড্ড একপেশে হয়ে গেল। আমি আর একটু টাফ গেম আশা করেছিলাম। তবে কাজটা করে মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল। কাহাতক বলুনতো কম্পিউটেশনাল থিংকিং নিয়ে, বউয়ের খোটা খাওয়া যায়। তার উপরে আমার আবার ইরেকটাইল ডিসফাংশন। এই অশান্তি টশান্তি হলেনা, পুরুষসিংহ ঘুম থেকে উঠতেই চায়না।
সকালে যখন, বাক্স আর বিলটা নিয়ে বেরোচ্ছিলাম, শ্রীমতীর একটা বুলি কানে খটাশ করে লাগলো,
‘হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল!’
পিত্তিটা দাউদাউ করে জ্বলে গেলেও, আমি কিছু বলিনি। শুধু শুধু শব্দ দূষণ বেড়ে যাবে।
শ্রীমতি সরখেলের এটা আরেকটা প্রতিভা। সে রাগ হোক, দুঃখ হোক বা আনন্দ। সব ধরনের অনুভূতির সাবলীল চরম প্রকাশের ক্ষমতা ওনার সহজাত।
গুন গুন গানের কলি ভেসে আসছে, ‘রাত শবনমি, ভিগী চাঁদনী, তিসরা কোই, দুর তক নহি, …. অউর কেয়া কহে, জানম সামঝা করো।’
রাত অবশ্য আমার ভালোই কেটেছে। গোলমালটা বাধলো সকালে। ফুরফুরে মেজাজে, ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে ড্রইং রুমে পায়চারি করছি। তখনো চশমা পড়িনি। তাই দৃষ্টিতে একটু ঝাপসা। ঝাপসা চোখে ডাইনিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে, আমার চক্ষু চড়কগাছ। টেবিলে দুদিকে, অবিকল একই রকম দেখতে, কাঠের কারুকার্য করা দুটো কাটলারি স্ট্যান্ড। অবিকল একই রকম দেখতে। একটাতে কাঁটাচামচ সব নতুন ঝুলছে। আর একটায় পুরোনো চামচ, ছুরি সুন্দর করে সাজানো। আমি ঘাবড়ে গিয়ে, দৌড়ে চশমাটা পড়ে এলাম।
আমার ভ্যাবাচাকা ভাবটা কাটার আগেই, শ্রীমতি কফির কাপ নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসতে বসতে বলল,
‘তুমি ঠিকই বল, এভরি প্রবলেম হ্যাস এ কম্পিউটেশনাল সলিউশন। কাটলারি সেটের সাথে, একটা স্ট্যান্ড দেবে। শুধু কাটলারি স্ট্যান্ড কিনতে পাওয়া যায় না। এদিকে বাড়িতে পুরনো কাটলারি রাখার জন্য একটা স্ট্যান্ডও দরকার। ওদিকে রিসোর্স লিমিটেড। দুটো কাটলারি সেট কেনার মতন টাকা নেই। দুটো কিনলেও সমস্যা, দুটোর সাথেই নতুন কাটলারি আর স্ট্যান্ড দেবে, তাতে পুরনোগুলো রাখার সমস্যা মিটবে না। তাই তোমার কম্পিউটেশনাল থিংকিং এর, থিওরি মেনে, প্রবলেমটাকে স্টেপ-বাই-স্টেপ ভেঙে, একটা সলিউশন কোড করেছিলাম। এক্সিকিউট করার পর বুঝলাম, তুমি ঠিকই বল, এভরি প্রবলেম হ্যাস এ কম্পিউটেশনাল সলিউশন।’
দাদা, সত্যি বলছি, আমি লোকটা কিন্তু এরকম নই। পুরো বোকা#& বনে গেলাম।
ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রতারণার সংজ্ঞাটা একবার ভালো করে দেখে নিলাম। আই.পি.সি. ধারা ৪১৫;
‘যদি কেউ কোনো ব্যক্তিকে ছলনা করে, প্রবঞ্চনামূলক ভাবে, বা অসাধুভাবে, সেই ব্যক্তি কে, বা অন্য কাউকে কোনো সম্পত্তি প্রদানে প্ররোচিত করে, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনুরূপ প্রতারিত ব্যক্তি কে এমন কোন কাজ করতে, বা কাজ করা থেকে বিরত থাকতে, প্ররোচিত করে, যে কাজটি ওই ব্যক্তি প্রতারিত না হলে করত না, বা কাজটি করা থেকে বিরত থাকত না, এবং কাজটি করার, বা করা থেকে বিরত থাকার ফলে, যে ব্যক্তিকে প্ররোচিত করা হয়েছে, সেই ব্যাক্তির বা তার সাথে সম্পর্কিত অন্য ব্যক্তির, দেহের, মনের খ্যাতির বা সম্পত্তি সংক্রান্ত ক্ষতির আশঙ্কা হয়, তবে সেই ছলনাকারী প্রতারণা করেছে বলে গণ্য হয়।’
ক’দিন ধরে কলিংবেল বাজলেই, বুকের কাছটা ধড়াস করে ওঠে। ওপার থেকে যদি কেউ বলে ওঠে, ‘দরজা খুলুন, পুলিশ।’
Copyright @ জুয়েল চন্দ।
Author
-
Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com
View all posts