ছোট গল্প: নদীয়া: খাটি গুজরাটি ব্রাহ্মন ছেলের সাথে মুসলিম মেয়ের ভালোবাসা, মাঝখানে অদৃশ্য ধর্মের প্রাচীর।

গুজরাটি ব্রাহ্মন ছেলের সাথে মুসলিম মেয়ের ভালোবাসা, মাঝখানে অদৃশ্য ধর্মের প্রাচীর
খাঁটি গুজরাটি নিরামিষাশী ব্রাহ্মণ সতীর্থ কাশ্যপ, মুসলিম মেয়ে জুবেদার সঙ্গে ঘোরাফেরা করছে জানতে পারলে, বাবা সোজা ভাবনগরে পাঠিয়ে দেবে। তাহলে উপায়? পড়ুন বাংলা ছোট গল্প প্রাচীর।

Share This Post

বাংলা ছোট গল্প: "প্রাচীর"

সতীর্থ কাশ্যপ জাতিতে গুজরাটি সম্প্রদায়ের হলেও ব্যবসার সূত্রে তাদের কলকাতায় তিন পুরুষের বাস। তাই পরিবারের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথাবার্তা হলেও পরিবারের সবাই বাংলা ভাষাটা বলা ভালোভাবে রপ্ত করে নিয়েছিলো। বিদ্যালয়ের পড়াশোনা ইংরাজী মাধ্যমে হলেও কলেজে পড়বার সময় বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলার ধরন ও দক্ষতা দেখে সবাই আদর করে বা উপহাস করে ‘বাঙালীবাবু’ বলে ডাকত। সতীর্থ হেসে বলত ‘এবার বাংলায় নোবেল প্রাইজ পাব’।

 

ইংরাজী অনার্সের ছাত্র হলেও বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে কলেজের পত্রিকায় দিত। কলেজের অধ্যক্ষ একদিন সতীর্থর খোঁজ করলেন। তিনি কলেজের পত্রিকায় সতীর্থ কাশ্যপের কবিতা পড়ে বেশ মোহিত হয়ে অবাক হয়েছিলেন। একজন গুজরাটি ছাত্র এমন ঝরঝরে বাংলায় কবিতা লিখতে পারে। তাই সতীর্থকে ডেকে আলাপ করতে চাইলেন। ছাত্র-ছাত্রী মহলে আলোড়ন পড়ে গেল। সবাই পারে তো সতীর্থকে কাঁধে করে তুলে এনে অধ্যক্ষের ঘরের সামনে এনে দাঁড় করায়।

 

অধ্যক্ষ সতীর্থর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে সামনের সোফায় বসতে বললেন। দরজার বাইরে উৎসুক ছাত্রছাত্রীরা উৎকন্ঠ হয়ে থাকল কথোপকথন শুনবার জন্য টেবিলের উপর পত্রিকাটি খোলা অবস্থায় রাখা ছিল। পত্রিকাটি হাতে নিয়ে অধ্যক্ষ সতীর্থকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এটা কি তুমি নিজে লিখেছ? এই ভাবনটা কোথা থেকে পেলে?’

 

অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সতীর্থ বলল, ‘কয়েকদিন আগে অনেক পুরনো একটা বাংলা সিনেমা টিভিতে দেখেছিলাম। তখন সাদা কালোর যুগ ছিল। সিনেমাটি যখন রিলিজ হয়েছিলো তখন হয়ত আমার জন্মই হয়নি। ফুটবল পাগল ছিল বাঙালী তখন। ক্রিকেটের এত রমরমা ছিল না। মোহনবাগান ও ইষ্টবেঙ্গল সমর্থকদের চাপান উতোর নিয়ে একটা সুন্দর মনোগ্রাহী ঘটনাবহুল ছায়াছবি ছিল।’

 

অধ্যক্ষ বললেন, ‘সে তো বুঝলাম। সিনেমাটির নাম ও ঘটনাগুলো একটু একটু মনে পড়ছে। তা খেলার মধ্য থকে একটা দস্যি মেয়ের চরিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে যে রোমান্স নিয়ে এসেছ তা তো তোমার মধ্যে শুধু শুধু আসবে না।’

 

এবার বাইরে সমবেত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হোল। সবাই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। কেবল একজন ছাত্রীই মাথা নিচু করে অসম্ভব উত্তেজনা বোধ করতে লাগল। সমবেত কারো তা চোখে পড়ে নি এই যা রক্ষে।

 

অধ্যক্ষের এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে সতীর্থ দু-এক মিনিট সময় দিলো। তারপর বলল, ‘আপনি নিশ্চই সিনেমাটি দেখেছেন। ছায়াছবিটির গান, গ্রাম্য পরিবেশ। ওই তরুণীটির গ্রাম জুড়ে দস্যিপনা, কথা বলার ভঙ্গীমা, চাহনী, আর সেই সঙ্গে তার নিষ্পাপ সৌন্দর্য্য আপনাকেও নিশ্চয়ই মোহিত করেছিলো। তাই আপনার এখনো মনে আছে। আর একটু কাব্যিক ভাব থাকলেই যে কেউ এমন কবিতা লিখতে পারে।’

 

অধ্যক্ষ এবার একটু হেসে বললেন, ‘তুমি সত্য গোপন করছ। যাই হোক তোমার কবিতাটি আমার ভাল লেগেছে। আরো ভালো লেখার প্রেরনা থাকল।’

 

বাইরে আসতেই সবাই মিলে সতীর্থ কাশ্যপকে চেপে ধরল, ‘কাকে নিয়ে সিনেমাটি দেখেছিস, সে কে রে?’

 

‘নিজের বাড়ীতে সবার সঙ্গে বসে দেখেছি। ফালতু তোরা ঝামেলা করিস না তো’, 

সবাইকে থামিয়ে দিয়ে সাময়ীক স্বস্তি পেলেও একজনার জন্য সতীর্থ উদ্বিগ্ন হলো। এই ভীড়ের মধ্যে তাকে তো দেখা যাচ্ছে না। যা মুখচোরা মেয়ে, লজ্জায় কুঁকড়ে হয়ত কোথাও বসে আছে। মনে মনে সতীর্থ ভাবল।

 

কলেজের গেট দিয়ে বেড়িয়ে কলেজ ষ্ট্রীটের দিকে সতীর্থ হাঁটছিল। ওখানে এক প্রকাশকের কাছে যাবে। ওখান থেকেই ওর প্রথম কবিতার বইটা বেরোবে। হঠাৎ পিছন থেকে পিঠে যেন কার আঙুলের আলতো টোকা অনুভব করল। পিছন ফিরে চাইতেই দেখে জুবেদাকে। মুহূর্ত্তের মধ্যেই মুখে আঙুল ঠেকিয়েই সতীর্থ জুবেদাকে নিয়ে মূল রাস্ত পেরিয়ে একটা চেনা রেষ্টুরেন্টে ঢুকে গেল।

 

সারি সারি চেয়ার পাতা আছে। আবার পর্দা দেওয়া কয়েকটা ছোট ছোট কক্ষও আছে। সতীর্থ জুবেদাকে নিয়ে পর্দা দেওয়া একটা কক্ষে মুখোমুখি বসল।

 

এতক্ষন জুবেদাকে কোন কথা বলতে দেয়নি। জুবেদার পুরো নাম জুবেদা সুলতানা। খাটি মুসলিম ঘরানার মেয়ে, সতীর্থ কাশ্যপের সহপাঠিনী। অবশ্য এখন তাদের মধ্যে আলাপটা একটু অন্য পর্যায়ের দিকে মোড় নিচ্ছে।

 

জুবেদা একটু অভিমানের সুরে বলল ‘এত রাখঢাক করে চুপি চুপি আমাকে নিয়ে এলে কেন? একবার যখন হিজাবের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি তখন তোমার এত কাঁচুমাঁচু অবস্থা কেন?’

 

সতীর্থ হেসে বলল, ‘তা হলে চলো প্রিন্সিপালকে বলে আসি যে এই মেয়েটিকে পাশে বসিয়েই সিনেমাটি দেখেছি।’

‘বললে না কেন? আমি কি বারন করেছিলাম?’

‘তাহলে সবাই মিলে এমন অবস্থা করত যে খবর তোমার বাপজানের কাছে পৌছে যেত। আর কলেজ আসতে হতো না। হিজাব ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।’

‘ক্ষতি কি ছিল? হিজাব পড়েই পড়াশুনা করতাম।’

‘ক্ষতি তোমার নয় আমার। আমার নাম সতীর্থ কাশ্যপ। খাটি গুজরাটি ব্রাহ্মণ, সম্পূর্ন নিরামিষাশী। একটা মহামেডান ঘরের মেয়ের সঙ্গে ঘোরাফেরা করছি জানলে বাবু আর কোন কথা নয় সোজা ভাবনগরের টিকিট কেটে তুলে দেবে। স্বখাত সলিলে ডুবে মরতে তখন তুমি।’

 

জুবেদা ফোঁস করে উঠল। ব্যঙ্গের স্বরে বলল, ‘ঈশ বয়েই গেল আমার ডুবে মরতে। তুমিই ডুবে হাসফাস করতে।’

জুবেদার মেজাজ দেখে সতীর্থ দুহাত জোড় করে বলল ‘ঠিক আছে বাবা, আমারা দুজনেই স্বখাত সলিলে ডুবে মরতাম। এখন কি খাবে বল।’

অন্যদিন ওরা একটা ডবল ডিমের ওমলেট একটাই প্লেটে নিত। দুটি কাটা-চামচ নিয়ে দুদিকে দিয়ে শুরু করে কেটে কেটে এ অন্যের মুখে পুরে দিত। আর তার সঙ্গ অর্থহীন টুকরো টুকরো আলাপে ডুবে যেতো।

 

আজ সতীর্থর ওই কথাটা, ‘খাটি গুজরাটি ব্রাহ্মন’ জুবেদার কানে ঢুকে অন্তরাত্মায় নানা প্রশ্ন তুলে দিলো। তারা দুজন ধর্ম ও জাতের দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছে। গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে যেভাবে মিশছে, ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করছে, কত না আলতো ছোঁয়াছুয়ি হয়েছে, কত না শিহরিত হয়েছে তা হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল। মন বলে উঠল “জুবেদা এটা ঠিক হয়নি” এ আবেগ আবেশ কেটে গেলে বাস্তব যখন সামনে এসে দাঁড়াবে তখন কোন যুক্তি দিয়ে তা সামলাবে। হৃদয়ের বৃত্তে হয়ত ভালবাসার স্পন্দন অনুভূত হতে শুরু করেছে তা আর উচিত হবে না স্পন্দিত হতে দিতে। মেলামেশাটা থাকবে না, সেখানে ধর্মীয় ব্যাপারটা একটা অলঙ্খণীয় প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে। সেটা ভাবতে ভাবতেই ওয়েটারকে ডেকে বলল, ‘দুটো আলাদা প্লেটে দুটি ডিমের মামলেট দিতে।’

 

চেনা ওয়টার এতদিন একই প্লেটে ডবল ডিমের মামলেট দিয়ে এসেছে। আজ হঠাৎ বদলে গেল কেন, তা ভেবে পেল না।

 

আর সতীর্থ অবাক চোখে জুবেদার দিকে তাকিয়ে শ্রাবনের জলভরা মেঘ দেখতে পেল। ব্যাপারটা সতীর্থ কিছুটা বুঝল কিছুটা বুঝতে পারল না। এতদিন তো একই প্লেটে খেয়ে এসেছে, গড়ের মাঠে একইভাবে দুটি স্ট্র দিয়ে একটি ডাব খেয়েছে, একই ঠোঙায় ঝালমুড়ি নিয়ে ভাগাভাগি করে খেয়েছে। এখন হঠাৎ জুবেদার অন্যরকম আচরন?

 

জুবেদা কি করে বোঝাবে সতীর্থ কাশ্যপকে, যে এতদিন যেভাবে মেলামেশা করেছে সেটা ভাললাগার সুত্র ধরে কিন্তু সেই ভাললাগা ক্রমশঃ ভালবাসায় রূপান্তরিত হতে চলেছে। এখনই সচেতন হবার সময়। ধর্মীয় দুই মেরুর দুটি যুবক যুবতীর ভালবাসার পথে অজস্র ধর্মীয় কাটা বিছানো রয়েছে। সেখানে শুধুই রক্তাক্ত হতে হবে। ধর্মীয় প্রাচীর ভেঙে এক উঠোনে মিলিত হতে গেলে আর এক জন্ম নিতে হবে। আর এক যুগের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে।

✍️দেবব্রত সাহা

Author

  • দেবব্রত সাহা

    আমি রসায়ন বিজ্ঞানের স্নাতক হলেও বাংলা সাহিত্যের প্রতি টান ছিল। কিন্তু ব্যাংকের কেরানী হয়ে ঢুকে অফিসার ম্যানেজার হয়ে কাজ করার সময় সাহিত্যের ধারা থেমে গিয়েছিলো। যাই হোক অবশেষে 2012 তে অবসর নিয়ে এখন কবিতা ছোট গল্প ও উপন্যাস লিখে সময় কাটে।

    View all posts

Subscribe To Our Newsletter

Get updates and learn from the best

More To Explore