[এই গল্পটা শুধু বিশ্বনাথবাবুর নয়। এটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার আকস্মিকতায় দিশেহারা হয়ে যাওয়া এক মেয়ের বাবার গল্প। দু একটা লাইনে সামান্য স্ট্রং ল্যাঙ্গুয়েজ আছে। যে সকল পাঠক স্ট্রং ল্যাঙ্গুয়েজ একেবারেই পছন্দ করেন না, তাদের কাছে আমি অত্যন্ত ক্ষমাপ্রার্থী। আর একটা কথা, এই গল্পের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। স্থান, কাল, পাত্র এবং নামের মিল পাওয়া গেলে ধরে নিতে হবে সেটা একেবারেই কাকতালীয়।]
অন্ধকার গলিটায় ঢুকে বিশ্বনাথবাবু ব্যাগের মধ্যে হাত গলিয়ে দেখে নিলেন, জিনিসটা ঠিকঠাক আছে কিনা। আঙ্গুলে একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ পেয়ে বুঝলেন, ওটা ঠিকই আছে। ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডাতেও বিশ্বনাথ বাবুর কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন, আটটা বাজতে পাঁচ। আর পাঁচ মিনিট। বিশ্বনাথ বাবু ঝোলা ব্যাগটার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে পিস্তলটা শক্ত করে ধরলেন। একটা যাচ্ছেতাই রকমের অনুভূতি হচ্ছে। বুকের মধ্যে কেউ এত জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে যে উনি বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছেন। পেটের ভেতরটায় কেমন জানি একটা হচ্ছে। উচু নাগরদোলা থেকে নামার সময় যেমন হয়, ঠিক তেমনি।
এমনিতে বিশ্বনাথ বাবুকে সবাই সাদামাটা নিপাট ভালো মানুষ বলেই জানে। ঝগড়াঝাঁটি তো দূরের কথা, আজ অব্দি ওনাকে কেউ গলা চড়িয়ে কথা বলতে পর্যন্ত শোনেনি।
এই নিয়ে আজ তিন নম্বর দিন। আজকে কাজটা যে করেই হোক করতেই হবে। নিতাই পই পই করে বলে দিয়েছে, কাজটা শুরু হওয়া পর্যন্ত একটু মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। একবার পিস্তলটা বার করে মাথায় ঠেকাতে পারলেই, বাকি ব্যাপারটা হড়হড় করে ঘটে যাবে। ব্যাপারটা গতকালই শেষ হয়ে যেত। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। গতকাল ঠিক এই সময়, দূর থেকে ছেলেটাকে আসতে দেখে, যেই না বিশ্বনাথবাবু ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়েছেন, অমনি ব্যাগের ভেতর থেকে মোবাইল ফোনটা ক্যাও ম্যাও করে করে বেজে উঠলো। মোবাইল ফোনের রিংটোন যে এত ভয়ঙ্কর হতে পারে, সেটা বিশ্বনাথবাবু এর আগে কোনদিনও টের পাননি। এমনিতে হতচ্ছাড়া মিউ মিউ করে নাকি সুরে কখন পকেটের ভিতরে বেজে ওঠে টের পাওয়া যায় না। ওনার স্ত্রী সুপ্রিয়াতো মাঝে মাঝেই বলেন,
“মোবাইলটাতো গঙ্গায় ফেলে দিতে পারো, কোনদিন তো দেখলাম না একবারে ফোন ধরতে।”
কথাটা অবশ্য ঠিকই। মোবাইলটা পকেটের মধ্যে যে কখন বেজে ওঠে, অনেক সময়েই উনি টের পান না। আর সেই হতচ্ছাড়া, কালকে মোক্ষম সময় এমন হাউমাউ করে বেজে উঠলো, যে বিশ্বনাথ বাবু ঘাবড়ে গিয়ে সটাং উল্টো দিকে হাঁটা লাগালেন। সেই জন্য আজকে আর মোবাইলটা আনেননি। আনার কথা অবশ্য গতকালও ছিল না। নিতাই আগেই বলে দিয়েছে মোবাইল নিয়ে এসব কাজ করতে যাওয়ার মানেই হলো, পুলিশের খাতায় নিজের অপকর্ম নিজেই লিখে রাখা। সে দিক থেকে দেখতে গেলে অবশ্য মোবাইলটা বেজে উঠে একরকম ভালই হয়েছে। তবে আজকে আর কোন ভুল নয়।
বিশ্বনাথবাবু ডান হাতটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে, পিস্তলটা শক্ত করে ধরে, বা হাতে রুমাল দিয়ে একবার কপালের ঘামটা মুছে নিলেন। আজকে আর ছেলেটার নিস্তার নেই।
বিশ্বনাথ বাবু মনে মনে ঠিক করলেন, বেপরোয়া নার্ভ গুলোকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। মেয়েটা ওনার বড্ড প্রিয়। সুপ্রিয়ার প্রেগন্যান্ট হবার খবরটা যেদিন বিশ্বনাথবাবু অফিস থেকে এসে প্রথম শুনেছিলেন, সবার প্রথমে উনি ঠাকুর ঘরে গিয়ে, হাঁটু গেড়ে বসে, হাতজোড় করে মা দক্ষিণা কালী কে বলেছিলেন,
“মা, একটা কন্যা সন্তান দিও।”
বিশ্বনাথ বাবু যখন বছর ছয়েকের, তখন একবার ওনার দাদুর মুখে শুনে ছিলেন, আক্ষরিক অর্থে উনি নাকি ওনার দাদুর আত্মীয় নন। দাদু মানে, মায়ের বাবা। দাদু বলেছিল, “আত্মার সাথে যোগ না থাকলে সে সঠিক অর্থে আত্মীয় হয় না। তোমার মায়ের বিয়ের পর তার গোত্র পাল্টে গেছে। তাই তোমার আর আমার গোত্র আলাদা। সেই দিক থেকে দেখলে দাদুভাই, তোমায় ঠিক আত্মীয় বলা যায় না।”
যদিও কথাটা দাদু মজা করে বলেছিল, নাকি সিরিয়াসলি, সেটা বোঝার মতন মনের বিকাশ তখনো বিশ্বনাথ বাবুর হয়নি। তবে ছোট্ট বিশ্বনাথবাবুর মাথায় সেই দিন থেকে জেদ চেপে গেছিল। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও বাবার সাথে তার আত্মার যোগ কাটেনা, একথা তিনি বড় হয়ে প্রমাণ করে দেবেন।
মেয়েটাকে তিনি বুকে করে মানুষ করেছেন। উনি গর্ব করে বলেন, যেমনি আমার কিডনি, লিভার, হৃদপিণ্ড, আমার শরীরের ভিতরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, তেমনি আমার মেয়ে হল আমার এক্সটেন্ডেড অর্গান। বিয়ের অনেক আগে থেকেই উনি ঠিক করে রেখেছিলেন মেয়ের নাম রাখবেন, আইভী। বিয়ের পর সুপ্রিয়া শুনে তো হেসে কুটোপাটি।
“আচ্ছা ধরো তোমার যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়।”
বিশ্বনাথবাবু রাগ দেখিয়ে বলতেন, “ছেলে হলেই হল, হলে আমার মেয়েই হবে।”
“আহা, ধরো যদি ছেলে হয়। তাহলে?”
“তাহলে আর কি, ডাক্তারবাবুকে বলবো, চুঙ্কুটা কেটে মেয়ে বানিয়ে দিন।” তারপর বর বউ দুজন মিলে হো হো করে হেসে উঠতো।
ঘটনাটা ঘটার পর থেকে, বিশ্বনাথবাবু তিনদিন রাতে ঘুমোতে পারেননি। রিনি গত ডিসেম্বরেই পনেরয় পড়েছে। মেয়ের গা থেকে এখনো বাচ্চা বাচ্চা গন্ধটা যায়নি। ওইটুকু মেয়েটাকে কিনা এই ছেলেটা….!
বিশ্বনাথবাবু চোয়াল শক্ত করে, শিরদাঁড়া সোজা করে, ডান হাতে পিস্তলটা শক্ত করে ধরে, কৃষ্ণচূড়া গাছ তলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। নিজেকে উনি বরাবর আদর্শ বাবা হিসেবেই দাবি করেন। আজকে সেটা প্রমাণ করার দিন।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ছেলেটা সাইকেল করে আসছে। বিশ্বনাথবাবু শরীরটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে একবার দুলিয়ে স্থির হয়ে গেলেন। ঠিক যেন একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে শরীরের সমস্ত পেশী টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে।
মনের ভিতর সেদিনের ঘটনাটা ঘুরেফিরে উঁকি দিচ্ছে। আবছা অন্ধকারেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, বিশ্বনাথ বাবুর চোখের কোনাটা চিকচিক করে উঠলো। সেদিনের পর থেকে মেয়েটার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলেন না। কলেজে ক্লাস নিতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলেন। নিজেকে কেমন জানি অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছিল। যেন ঘটনাটার জন্য উনিই দায়ী।
তিন নম্বর দিন, নিতাই কলেজের করিডোরে দেখা হতেই বলল, “স্যার সমস্যাটা কি? যদি আমাকে একটু খুলে বলেন, তাহলে আমি কিছু সুরাহা করতে পারি। অবশ্য পারবই এটাতো আর সার্টেন নয়। তবে একজনের বদলে দুজন মাথা লাগালে সমস্যা সমাধানের প্রবাবলিটিটা একটু বাড়ে।”
নিতাই কলেজের হেডক্লার্ক হলেও, বিশ্বনাথবাবু আর নিতাই একেবারে ছেলেবেলার বন্ধু। স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত। দুজনেই স্ট্যাটিসটিক্স। কলেজ শেষ হওয়ার পরে নিতাই সরকারি চাকরির জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। আর ওদিকে বিশ্বনাথবাবুর টার্গেট নেট পরীক্ষা। যে বছর বিশ্বনাথবাবু নেট পরীক্ষা দিয়ে জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পান, সেই বছরেই নিতাই ইউনিভার্সিটি তে জয়েন করে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে। পরবর্তীকালে একই ইউনিভার্সিটিতে বিশ্বনাথ বাবু অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেন। পদ আর পদমর্যাদা কখনো দুই বন্ধুর বন্ধুত্বে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তবে কলেজে সর্বসমক্ষে নিতাই স্যার বলে সম্বোধন করে, আর আপনি করে কথা বলে। প্রথম প্রথম বিশ্বনাথবাবু আপত্তি করেছিলেন বটে, তবে সে আপত্তি ধোপে টেকেনি।
নিতাইয়ের সোজা কথা, “প্রফেসর ক্লার্ককে তুই তোকারি করছে এটা তাও মানা যায়, কিন্তু ক্লার্ক প্রফেসরকে তুই তোকারি করছে, এটা ভাই বড্ড আনরিজনেবল। আমাদের সোসাইটি একসেপ্ট করবে না।”
বাহ্যিক ব্যবহারের এমন চূড়ান্ত পেশাদারিত্ব অবশ্য ইউনিভার্সিটির গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ইউনিভার্সিটির গন্ডি পেরোলেই বন্ধুত্বের ভাষা চার অক্ষরে নেমে আসে।
বিশ্বনাথবাবু বললেন, “সমস্যা? কিসের সমস্যা?”
নিতাই কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল,
“তিনদিন ধরে দেখছি মুখটা পারুল ম্যাডামের গাঁড়ের মতন করে ঘুরছিস। কি হয়েছে? এইডস?”
বিশ্বনাথ বাবু মাথাটা ঠিক রাখতে পারলেন না। একটু জোরেই বলে উঠলেন,
“ধুর বাল। সব সময় ইয়ার্কি ভালো লাগেনা।”
কথাটা বলেই বিশ্বনাথ বাবু চারিদিকটা ভালো করে দেখে নিলেন। নাহঃ, কেউ শোনেনি। ছেলেপুলেরা শুনতে পেলে, কেলেঙ্কারি ব্যাপার হতো।
নিতাই হঠাৎ দেখে, বিশ্বনাথ বাবুর সারা শরীর মৃগী রোগীর মত থর থর করে কাঁপছে।
নিতাই ঘাবড়ে গিয়ে বলে ওঠে, “একি! তুই ওরকম করে কাঁপছিস কেন। বিশু, কি হয়েছে? মলয়, সুজিত, আরে সব গেলি কোথায় তাড়াতাড়ি আয়।”
নিতাইএর চিৎকারে, সবাই ছুটে এসে বিশ্বনাথ বাবুকে টিচার্স রুমে নিয়ে গিয়ে বসায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার বাবু এসে সমস্ত রকম চেক করে, বললেন,
“শারীরিক কোনো সমস্যা বলে তো মনে হচ্ছে না। তবে ডিপ্রেশনের কারণে হঠাৎ করে এরকম নার্ভাস ব্রেক ডাউন হতে পারে। সেটা অবশ্য আমার ডোমেইনে পড়ে না। তবে আমার মনে হয় উনি কোন কারনে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। তবে তেমন চাপের ব্যাপার বলে তো মনে হলো না। কদিন একটু রেস্ট নিলেই আশা করি ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রিন্সিপাল স্যারের নিদানে, ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ার পরেই, নিতাই বিশ্বনাথ বাবুকে ট্যাক্সিতে তুলে বাড়ি পৌছে দেওয়ার জন্য রওনা হয়ে পরে।
সব শুনে নিতাইয়ের মুখটাও থমথমে হয়ে যায়।
“কত যেন বয়স তোর মেয়ের, পনের?”
বিশ্বনাথবাবু গম্ভীরভাবে বলেন, “হম্।”
“থানা পুলিশ করে কোন লাভ হবে না বুঝলি। মাঝখান থেকে কয়েকটা জার্নালিস্ট আমাদের মেয়েটাকে নিয়ে রগরগে গল্প লিখে কয়েকদিন কামাই করে নেবে। ছেলেটাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা, যাতে শুধু ও কেন, এলাকার কোন ছেলেই আর জীবনে এমন কাজ করার কথা স্বপ্নেও না ভাবতে পারে।”
পিস্তলটা অবশ্য নিতাই জোগাড় করে দিয়েছে। এসব কাজে নিতাই কলেজে পড়ার সময় থেকেই দক্ষ। একসময় নাকি নকশালেও নাম লিখিয়েছিল। মেড ইন চায়না। নিতাই পই পই করে বলে দিয়েছে, অপরপক্ষকে কোন রকম সুযোগ দেওয়া যাবে না। রেঞ্জের মধ্যে এসে গেলেই, পিস্তলের নলটা ডাইরেক্ট মাথায় ঠেকাতে পারলেই, বাকিটা কাজটা একদম সহজ হয়ে যাবে। ওই মাথায় ঠেকানো পর্যন্তই নার্ভের কন্ট্রোল লাগে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যাবে না। এসব কাজে এক এক মুহূর্ত সময় বহুগুণ রিস্ক বাড়িয়ে দেয়। চার মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে, নিতাই ঘনঘন সিগারেট টানতে থাকে। ঘড়িতে প্রায় আটটা কুড়ি। সব ঠিকঠাক থাকলে বিশ্বনাথবাবুর এতক্ষণে চলে আসার কথা। এদিকে আবার বা চোখটা কটকট করছে। লক্ষণ ভালো নয়। নিতাই মনে মনে ভাবে, আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। ওদিকে কিছু বিপদ হলে এখনই কিছু অ্যাকশন নিতে হবে। বিশুটা চিরকাল সাদামাটা ভালো মানুষ। স্কুল জীবনে একবার মারামারি পর্যন্ত করেনি।
নিতাই অবশ্য বলেছিল, “কাজটা তুই আমাকে করতে দে। তুই সাদামাটা ভালো মানুষ, এসব কাজ কিন্তু সবার দ্বারা হয় না।”
কিন্তু বিশ্বনাথ বাবুর সাফ কথা, “মেয়েটা যে আমার। ওর শরীরের যে যে জায়গাগুলোতে শুয়োরের বাচ্চাটা হাত দিয়েছে, সেই জায়গা গুলোর রক্ত মাংস সব আমার রক্ত মাংস দিয়ে তৈরি। তাই কাজটা আমাকেই করতে হবে।”
নিতাই হনহন করে গাছ তলার দিকে এগোতে থাকে। চালতাবাগান এর গলিতে বাঁদিকে ঢুকেই, একি! নিতাই থমকে দাঁড়ায়। এক মুহূর্তের জন্য, ওর মেরুদন্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।
সাইকেলটা যখন হাতখানেক দূরত্বে, বিশ্বনাথ বাবু অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েন। ডান হাতটা দিয়ে ব্যাগের ভিতরে পিস্তলটা শক্ত করে ধরা। ছেলেটা কোনরকমে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিশ্বনাথবাবু পিস্তলটা বের করে মাথায় ঠেকাতে যাবেন, এমন সময় ছেলেটা হঠাৎ বলে ওঠে, “আরে, স্যার? আপনি এখানে?”
বিশ্বনাথবাবু কিছু বোঝার আগেই, ছেলেটা সাইকেল থেকে নেমেই ঢপ করে বিশ্বনাথবাবুর পা ছুয়ে একটা প্রণাম করতে করতে বলে ওঠে,
“আপনি স্যার আমাকে নাও চিনতে পারেন। তবে আমি আপনাকে চিনি। রিনি সবসময় আপনার কথা বলে। এদিকে কোন কাজ ছিল স্যার? আমায় বলতে পারেন আমার বাড়ি এই কাছেই।”
সেটা অবশ্য বিশ্বনাথবাবু বিলক্ষণ জানেন, গত সাতদিন ধরে উনি আর নিতাই পালা করে ছেলেটাকে ফলো করেছেন। দুই বন্ধু মিলে একটা ভয়ঙ্কর অপরাধের ফুলপ্রুফ প্লান করেছেন। এই ছেলেটাকেই সেদিন তিনি রিনির সাথে পার্কে দেখেছিলেন। আবছা অন্ধকারে উনি স্পষ্ট দেখেছেন, ছেলেটার হাত দুটো রিনির গেঞ্জির ভিতর ঘোরাফেরা করছে। সঙ্গে একটা পিস্তল থাকলে তখনই হতচ্ছাড়াটাকে গুলি করে মারতেন।
বিশ্বনাথ বাবুর সব গুলিয়ে যায়, উনি লক্ষ্য করেন ওনার ডান হাতটা কখন ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এসেছে। হাত খালি। তারমানে পিস্তলটা এখনো ব্যাগের মধ্যে। উনি ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “তোমাকে দেখে তো রিনির বয়সী মনে হচ্ছে না। রিনিকে তুমি চিনলে কি করে?”
“না না রিনির থেকে আমি খুব বেশী বড় না স্যার, আমার ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফার্স্ট ইয়ার। রিনির সাথে আমার অনেক দিনের বন্ধুত্ব।”
বিশ্বনাথবাবু মনে মনে হিসেব কষেন, ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফার্স্ট ইয়ার। তারমানে ছেলেটা রিনির থেকে বছর পাঁচেকের বছরের বড়। কথাবার্তা শুনে তো ভদ্র ঘরের ছেলেই মনে হচ্ছে। বিশ্বনাথবাবু বেমালুম ভুলে গেছেন, পিস্তলটা মাথায় ঠেকিয়েই, বলার কথা, “শুয়োরের বাচ্চা ফের যদি রিনির সাথে কোনদিনও দেখেছি, তোর মাথায় এতগুলো গুলি করবো যে বাড়ির লোকেও চিনতে পারবে না।”
নিতাই পই পই করে বলে দিয়েছে, “বিশু মনে রাখবি, মাথা ঠান্ডা রেখে ডায়লগটা বলতে হবে। উত্তেজিত হয়ে খটাস করে ট্রিগারটা টেনে দিসনা। একেবারে আসলের মত দেখতে হলেও বন্দুকটা কিন্তু আসলে নকল। হঠাৎ খটাস করে আওয়াজ হলেই মুশকিল।”
“তা রিনির বন্ধু যখন, তখন স্যার বলছ কেন। বন্ধুর বাবা কে কেউ স্যার বলে নাকি?”
“না স্যার, তা বলে না। সরি, ইয়ে, মানে কাকু।”
বাঁ দিকটা ঘুরেই নিতাই দেখে, বিশ্বনাথবাবু আর সেই ছেলেটা গল্প করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসছে। নিতাই কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে, সটাং উল্টো দিকে ফিরে হন হন করে হাটা লাগায়।
বিশ্বনাথবাবু দেখেন, নিতাই মোরটা ঘুরে ওদের দেখেই, উল্টো দিকে ঘুরে হনহন করে হাঁটা লাগালো। উনি চেঁচিয়ে ওঠেন,
“এই নিতাই। আরে ও নিতাই।”
নিতাই দাঁড়িয়ে পড়ে। পালাবার কোনো পথ নেই। নিতাই ওদের দিকে ঘুরতেই, বিশ্বনাথবাবু ছেলেটাকে বলে ওঠে, “ওইযে নিতাই, আমার বন্ধু। ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।”
উনি নিতাই দিকে তাকিয়ে বলেন, “এ হলো, আমাদের রিনির বিশেষ বন্ধু। ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফার্স্ট ইয়ার। ভালো ছেলে। প্রায় রিনির বয়সী।”
বিশ্বনাথ বাবুর হঠাৎ খেয়াল হয়, ছেলেটার নামটাই জানা হয়নি।
তোমার নামটা কি যেন বাবা।
“উৎস কাকু।”
নিতাই বোকার মতন বলে ওঠে, “বাবাঃ, উৎস কাকু। ভারী অদ্ভুত নাম তো।”
“আরে না না, উৎস কাকু নয়। কাকু কে বললাম তাই। আমার নাম উৎস সরকার। ডাক নাম উসী।”
বিশ্বনাথ বাবু এবার বুঝতে পারেন, এই উসী বন্ধুটির গুণকীর্তন উনি রিনির মুখে অনেকবার শুনেছেন। তবে উসী যে পুং লিঙ্গ হতে পারে সেটা ওনার ধারণার বাইরে ছিল।
সে যাক গে। নিতাই কে দেখে ওনার ধরে প্রাণ এলো। উনি ছেলেটা যে বললেন, “আসি বাবা উসী, পরে দেখা হবে। সাবধানে থেকো, দিনকাল ভালো নয়।”
নিতাই মুখ ফসকে বলতে যাচ্ছিল, “হ্যাঁ সন্ধ্যের পরে পার্কে টার্কে যাওয়া তো একদমই ঠিক নয়।”
বলেই ফেলত, যদি বিশ্বনাথবাবু মোক্ষম সময় কনুইয়ের এক গুঁতো দিয়ে ওকে না থামাতো।
Copyright © Jewel Chanda
Author
-
Advocate Jewel Chanda is an accomplished legal professional with over 15 years' experience in the legal field. He has served as a Judge for 10 years in the West Bengal Judiciary and is currently practicing before the High Court at Calcutta and in various Trial Courts of the District Judiciary. A Gold Medalist, Mr. Chanda holds two Bachelor's degrees, one of which is Law, along with four Master's degrees in Law (Criminology), Business Law, Environment & Development and Sociology. He is also a Doctoral Research Scholar of Jindal Global Law School whose research area focuses on Artificial Intelligence and Law. With exceptional expertise in both civil and criminal litigations including family matters and property matters, Advocate Chanda is highly trained to handle trials, appeals and revisions. He is well-versed in all aspects of the law and litigation, making him an invaluable asset to protect the legal rights of the poor and weaker section of the society. Contact Advocate Chanda at jewelchanda@gmail.com
View all posts